কাকলী তালুকদার:
ঘরে স্বামী-স্ত্রী ছেলে-মেয়েসহ তাঁরা ছয়জন। গোয়াল ঘরে ১২টি গরু, একটি বিড়াল ও একটি কুকুরসহ ২০ জনের সংসার। বছরে জমি যতটুকু করা হয়, ভাল ফসল হলে বিশ জনের সংসার টেনেটুনে কোনরকম চলে যায়। কিন্তু গত কয়েক বছরের ফসল ডুবে যাওয়ার পরেও আজন্ম কৃষক মাটি আঁকড়ে এবারও ফসল ফলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এবার হাওরের পানি দেরিতে সরাতে কৃষক ধানের চারা রোপন করেছে একটু দেরিতে। তাই চৈত্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ধান পাকার কথা থাকলেও এবার একটু দেরিতে ধান পাকবে। কিন্তু অসময়ে বৃষ্টির পানি বাঁধ ভেঙে হাওরে ঢুকে যাওয়ায় কৃষক আজ দিশেহারা। সেই অসহায়ত্ব সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়ে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছে কুড়ি সদস্য সংসারের কর্তা।
শ্রমিক স্বামীর সাথে গতর খাটিয়ে অমরি এক হারা জমি করেছে এবার। কোলে দুধের বাচ্চা নিয়ে অমরি সেই জমি দেখতে যায়। কাঁচা জমি পানিতে ডুবে যাচ্ছে দেখে অমরি জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফেরার পর দেখতে পায় কোলের শিশু পানিতে লাশ হয়ে ভেসে আছে। কাঁচা ক্ষেত ডুবে যাচ্ছে চোখের সামনে,জ্ঞান আরও অনেকেই হারাচ্ছে।
কেউ কেউ কাঁচা ধান নিজেরাই কেটে আনতে পানিতে নেমেছে। ঘরের গরু গুলো কি খাবে, সেই আশায়। বেপারি আসবে চৈত্রের শেষে ধান পাকলে। গতবারও পাকা ধান ডুবে গেলো ভাটি অঞ্চলের কৃষকের। লক্ষ লক্ষ টন ধান ডুবে গেলো। সেই ধান ফলাতে কৃষক তাঁর শরীর, সম্বল সব কিছু নি:শেষ করেছিল। যাদের নিজেদের শ্রম দেয়ার ক্ষমতা নেই তাদের জমি পত্তন দেয়ার চেষ্টা করেন।
কিন্তু কে নিবে পত্তন? পত্তন নিতে গেলেও তো ফসল ফলতে হয়। আর ফসল হলে ফসলের দাম থাকে না বাজারে। পলি পড়ে যাওয়া নদীগুলো আজ সমতল ভূমির মতো। যে বাঁধগুলো হাওরের রক্ষা কবচ, সেগুলোও সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি খুব সহজে ঢুকে যাচ্ছে হাওরে। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কৃষকের জীবিকা।
কৃষক জানে এই দেশের সরকার, বিরোধী দল, কোন কল্যাণমূলক সংস্থা তাদের পাশে দাঁড়াবে না। এর আগে কেউ দাঁড়ায়নি তাদের পাশে তাই কেউ কেউ নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে মৃত্যুর কাছে আশ্রয় নেয়। তাতে অবশ্য এলাকার এমপি মন্ত্রীদের কিছু যায় আসে না। ভোট দরকারি হলেও ভোট প্রদানকারী মানুষগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঠিক যেমন বাংলার কৃষক মরে গেলেও উঁচু তলার ডাইনিং টেবিলে বাসমতি ভাত কোনদিন কম পড়বে না।
আমদানিতে আমরা বাঙালী এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছি। দেশী স্টাইলে আড়ং এ পাটজাত পণ্য থাকলেও বাংলার কৃষকের ঘরে এখন পাট মিলে না। মহাজনের কাছে ঋণের বোঝা বেড়েই চলছে কৃষকের। বোকা কৃষক বাপ-দাদার পেশায় পড়ে থাকে মাটি কামড়ে। ঋণের বোঝা একদিন মৃত্যুর চেয়েও ভারী হয়ে যায়। কিছুটা হালকা হতে কৃষক তাঁর জমিতে পোকা- মাকড় নিধনে যে বিষ প্রয়োগ করে সেই বিষে নিজেকেও নিধন করে।
সার, ডিজেল, পোকা- মাকর নিধন কোম্পানিগুলোও মুনাফা পেয়ে যায় কৃষকের কাছ থেকে বৃষ্টির আগেই। বোকা কৃষক সহজে বুঝে যায়, কীটনাশক বিষ বা ইউরিয়া সারের হিসাব। অথচ বুঝে না ধানের বাজার, পলি পড়া নদীর গভীরতায় আকাশের কান্নার জল ধারণ করা যায় না।
বোকা কৃষক বুঝে হাওরের বাঁধগুলো তাদের চোখের মতো। তাই দুঃখের মতো, চোখের পানিও বেঁধে রাখতে হয় ঠিক যেমন বেঁধে রাখতে হয় হাওরের বাঁধগুলো। কৃষকের স্বপ্ন প্রতি বছর ডুবে যায় পানিতে। আমরা হাহাকার করি প্রতি বছর, কিছুদিন পর আবার ভুলে যাই। সময়ের বৃষ্টি অসময়ে আসে কৃষকের ঘরে।
ভাঙা চালের ফুটো বছর বছর বড় হয়, এবার ফসল ভালো হলে ঘরের চালের টিন বদলাতে হবে। মহাজনের দেয়া সুদের অন্তত অর্ধেক ঋণ পরিশোধ করবে। ছেলেমেয়েগুলো হাই স্কুলে ভর্তি হবে। বছরে একবার সবাইকে কাপড়-চোপড় কিনে দিতে হবে।
আহা বাংলার কৃষক, ভাটির কৃষক, তোমরা এতো অসহায় কেনো! তোমাদের স্বপ্নগুলো শুধু পানিতে ভেসে যায়, অথচ তোমার দেশের অর্থমন্ত্রী বলে চুরি যাওয়া আটশ (হাজার, লাখ) কোটি টাকার হিসেব নাকি খুব নগণ্য! তুমি তবে কত নগণ্য কৃষক?
তোমার চেয়েও নগণ্য তোমার ভেসে যাওয়া স্বপ্নগুলো। তোমার হাতে যে কীটনাশক তুলে দিয়েছে মুনাফালোভী কোম্পানি, সেই বিষ দিয়ে নিজেকেও পোকার মতো নিজেকে হত্যা করছো তুমি। সময় বদলেছে, শিক্ষাহীন বটবৃক্ষের মতো কৃষক, জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে, সেই খবর তোমার কাছে যায় না, অথচ লাঙ্গল ছাড়িয়ে মেশিনের খবর পৌঁছে যায় বাতাসের আগে।
নদীতে পলি পড়েছে, পলি পড়েছে রাষ্ট্র নায়কদের চোখে, মনে। বাংলার কৃষক তুমি আজ অসহায়, নিঃস্ব, তোমার কেউ নেই তুমিই তোমার, বাঁচো বা মরো।
এপ্রিল ৩ /২০১৭ কানাডা