রাফী শামস্:
আমরা আসলে অত্যন্ত নিরানন্দ একটা জাতি। সেই অর্থে আমাদের কোন সত্যিকারের উৎসব নেই। আমরা যে উৎসব গুলো পালন করি সেগুলো কৃত্রিম এবং অনেকাংশেই চাপিয়ে দেয়া। সত্যিকারের বাঁধ ভাঙা আনন্দ, উল্লাস আর উদযাপনের তেমন কোন সুযোগ আমাদের নেই।
মুসলমানদের ঈদে সেই অর্থে আনন্দ করার কোন ব্যবস্থা নেই। ছোটবেলা থেকে আমরা শিখে এসেছি ‘ঈদ মানে আনন্দ’, ঈদের চাঁদ দেখা বিশাল খুশির ব্যাপার ইত্যাদি। লক্ষ করলে দেখবেন, এই ব্যাপার গুলোকে আমরা আনন্দ হিসেবে নেই,কারণ আমাদের সেভাবেই শেখানো হয়েছে। সেই অর্থে ঈদ কোন আনন্দ উৎসব নয়, বরং সামাজিকতা রক্ষা-সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ আর খাওয়াদাওয়া করার একটা ধর্মীয় উপলক্ষ মাত্র। স্বভাবতই সেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অংশগ্রহণের সুযোগ খুব কম!
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা গুলোতে যদিও সকল ধর্মের মানুষই অংশ নিতে পারে (অংশ নেয়া বলতে পূজা করা বুঝানো হয়নি) তাই এগুলো কিছুটা সার্বজনীন। সার্বজনীন হলেও এটা ধর্মীয় উৎসব,তাই এগুলো সম্পূর্ণরূপে সকলের না।আমাদের,অর্থাৎ বাঙালিদের, এক এবং একমাত্র সার্বজনীন উৎসব,যাতে কোন ধর্মের রঙ নেই, যাতে আমরা মেতে উঠতে পারি নির্মল আনন্দে, সেই উৎসবটি হল নববর্ষ উদযাপন – পহেলা বৈশাখ।
কিন্তু নিরানন্দ ও তমসাচ্ছন্ন চরিত্রের একটি গোষ্ঠী এই উৎসবটিকেও ধর্মীয় চেহারা দিতে বধ্য পরিকর। তাদের ভাষায় এটি ‘হিন্দুয়ানী’। আত্মপরিচয় সংকটে ভোগা এই মূর্খরা নিজেদের অন্ধকার ছড়িয়ে দিতে চায় গোটা দেশে।
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি উৎপাতের বিপরীতে মসজিদ গুলো থেকে জুমার নামাযের পর কি জঙ্গিবিরোধী মিছিল সমাবেশ হতে পারতোনা? (যেহেতু তাদের দাবি জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই) মিছিল সমাবেশ হয়েছে ঠিকই কিন্তু তা জঙ্গিবাদের বিরূদ্ধে না, পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরূদ্ধে!
মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম উদযাপিত হয় ১৯৮৯ সালে, চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে। ১৯৮৮ সালে জয়নুল আবেদীনের জন্মবার্ষিকীতে জয়নুল উৎসব নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে চারুকলার একদল ছেলে-মেয়ে বিশাল বিশাল রঙ তুলি, রঙের টিউব ইত্যাদি তৈরি করে। সেখান থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার আইডিয়ার জন্ম হয়,যদিও এর আগে ঢাকার বাইরে যশোরে ছোট আকারে এটি আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির মোটিফগুলোকে বৃহৎ আকারে তৈরি করে উপস্থাপন করাই ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য।
শুরু থেকেই এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায় এবং নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য সার্বজনীন উৎসব হিসেবে জায়গা করে নেয়। দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য গুলোকে তুলে ধরে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে পুরানো বছরের জঞ্জাল গুলোকে ধুয়ে-মুছে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতেই এই আনন্দ শোভাযাত্রা।
২০১৩ সালে গণজাগরণের সেই সময়ে, যে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি হয়েছিল সেখানে স্থান পেয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের হিংস্রতা আর তাদের বিচারের প্রতীকি চিত্র। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ইউনেস্কো।জাতিসংঘের এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হলে সেই আচার বা ঐতিহ্যকে রক্ষার দায় বর্তায় সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের ওপর!
নতুন একটা কথা শোনা যাচ্ছে এরকম, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা যেহেতু কিছুদিন আগে পালন করা শুরু হয়েছে তাই এটা আমাদের ঐতিহ্য নয়।’ যেকোন লোকাচার, ঐতিহ্যে পরিণত হয় বহু বছরের ক্রমাগত চর্চার ফলে। যদিও মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন করা শুরু হয়েছে অপেক্ষাকৃত বর্তমানে, তাই বলে কি এটা আমাদের ‘ঐতিহ্য’ নয়? এখানে প্রদর্শীত পাপেট, পুতুল গুলো কি আমাদের ঐতিহ্য গুলোকে প্রকাশ এবং ধারণ করেনা? আনন্দ আর উৎসাহের সাথে নতুন উদ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার সাথে ঐতিহ্যের সংঘর্ষটা কোথায়?
বাঙালি যেকোন উপলক্ষকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে বাতিল করে দেয়াটা নতুন কিছু নয় অবশ্য। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোটাও এদের কাছে ‘হিন্দুয়ানী’। পূজার সময় মণ্ডপে গিয়ে কুশল বিনিময় করা কিংবা স্রেফ পূজার শুভেচ্ছা জানানোটাও এদের কাছে খোদার আরশ কাঁপিয়ে দেয়া কবিরা গুনাহ! শিক্ষার অভাব এর পিছনের কারণ নয়। অনেক শিক্ষিত মানুষজনও মনে করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া পাপ, পহেলা বৈশাখ উদযাপন হিন্দুয়ানী ব্যাপার। এর মূলে রয়েছে আত্মপরিচয় সংকট।
আমাদের প্রায় সকলের বংশ লতিকা অনুসরণ করে পিছনের দিকে যেতে থাকলে দেখা যাবে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। হিন্দু ধর্মের পার্বণগুলো আসলে গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের বিভিন্ন উপলক্ষের পরিবর্তিত পরিবর্ধিত রূপ। ফলে এখানে বহু বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সংস্কৃতির যোগসাজশে বাঙালিদের নিজস্ব কিছু লোকাচার তৈরি হয়েছে। এই লোকাচার গুলো মোটেও কঠিন কিছু ছিল না, ছিল সহজীয়া ধরনের। সুফি সাধকদের দ্বারা প্রচারিত ইসলাম তাই সহজেই প্রবেশ করেছে সাধারণের জীবনে,পরিণত হয়েছে লোকাচারের অংশ হিসেবে।
যখন এদেশে ওয়াহিবিজমের চর্চা শুরু হলো সৌদি পেট্রো ডলারের আশীর্বাদে, গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের নামে শুরু হলো সাধারণের মগজ ধোলাই, তখনই সূত্রপাত সমস্যার। ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞ মানুষ, নূরানী চেহারার মোল্লাদের ধর্মীয় ছবক পেয়ে ভীত হয়ে পড়লো। তারা বুঝতে পারলো,তারা আসলে ‘প্রকৃত মুসলিম’ নয়। হাজার বছরের পালিত ঐতিহ্যের বিপরীতে মরূর দেশের সংস্কৃতিকে মনে করলো তারা নিজেদের জন্য অনুসরণীয়। একদিকে নিজেদের লালিত পালিত লোকাচার, একদিকে পরকালের ভয়ে ভীত হয়ে পালিত আচার সমূহের মাঝে পড়ে জন্ম নিলো সব থেকে ক্ষতিকর প্রশ্নটির- আমরা বাঙালি না মুসলমান?
বাঙ্গালিত্ব আর মুসলমানিত্বের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি যারা করেছিল,তাদের উদ্দেশ্য হয়তো ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক কিন্তু কালক্রমে এই দ্বন্দ্ব জন্ম দিয়েছে অসংখ্য সত্যিকারের সমস্যার। বাঙ্গালিত্বের সাথে মুসলমানিত্বের দ্বন্দ্ব আসলেই আছে কিনা, সেই বিতর্কে যাচ্ছিনা, তবে এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে মুসলমানিত্ব বিজয়ী হবে, এতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ পরকালীন পুরষ্কারের আশা দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার রসদ, আর ইহকালীন বিভিন্ন ধর্মীয় কর্ম ধনীদের অপকর্ম আড়ালের সব থেকে বড় হাতিয়ার। ধর্মের তীব্র আবেশ সৃষ্টিকারী আফিমের সাথে বাঙ্গালিত্বের কোন তুলনা হয় না।
তাই ‘বাঙালি না মুসলমান’ এই অবান্তর প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশই বেছে নিয়েছে দ্বিতীয়টিকে, এবং যা কিছু জড়িত বাঙ্গালিত্বের সাথে সেগুলোকে বাতিল করে দিয়েছে বা দেয়ার চেষ্টা করেছে। বাদ দিতে না পারলেও নামকরণ করেছে বিদাত,শিরক, কুফরী ইত্যাদি বিজাতীয় নামে।এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ যদি আবেগের বশে বলে বসে ‘আমি বাঙালি’ তাহলে তাকে কাফির,মুরতাদ ঘোষণা দেয়াটাও নতুন কিছু নয়।
অথচ অত্যন্ত সহজ এই প্রশ্নের উত্তরটি কেউ বুঝতে চাচ্ছে না। আমি চাইলেই ধর্ম বদলাতে পারি, ধর্ম ত্যাগও করতে পারি। কিন্তু চাইলেই আমি বাঙালি থেকে ইংরেজ বা চাইনিজ হয়ে যেতে পারবো না। বাঙালি আমার শেকড়ের পরিচয়, যাকে আমি গ্রহণ করতে না পারি, অস্বীকার করতে পারবো না। অন্যদিকে আমি মুসলমান কিনা, সেটা পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার উপরে নির্ভরশীল এবং অবশ্যই পরিবর্তনশীল।
তাই মোল্লারা যখন বলে- ‘এটা মুসলমানের দেশ, এখানে এটা হতে পারবে না, সেটা থাকতে পারবে না…’ তখন আমরা শংকিত হই, একই সাথে হই ক্ষুব্ধ। প্রথমত, এটা ‘মুসলমানের দেশ’ না, এটা বাঙালিদের দেশ, সেই সাথে আছে দেশের আদিবাসীরা। এখানে যেমন মুসলমান আছে, তেমনি আছে অন্যান্য ধর্ম ও জাতির সদস্যরা। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। সেটা হলে পাকিস্তান হিসেবেই থেকে যেতাম আমরা।
দ্বিতীয়ত, কোনটা পালিত হতে পারবে, কোনটা পালিত হতে পারবেনা- এটা নিয়ে ফতোয়া দেয়ার অধিকার কারো নেই। যদি ধর্মীয় বিধান অনুসারে, আপনার কাছে মনে হয় এই উৎসবে অংশ নিতে আপনার ধর্মীয় বাধা আছে, তবে আপনি ঘরে বসে কাসাসুল আম্বিয়া পড়ুন, আপনাকে কেউ জোর করে ধরে আনবে না। কিন্তু সেটা বাতিল করে দেয়ার হুমকি দেয়ার অধিকার আপনার কেন, কারোরই নেই।
এই অসভ্য মূর্খরা কিন্তু আমাদের জন্য কোন দুশ্চিন্তার ব্যাপার ছিল না। এদেরকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনার কিছু ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো আমাদের রাষ্ট্র স্বয়ং এদেরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যারা শুদ্ধভাবে দু পাতা লিখতে পারে না, তাদের হুমকিতে আমাদের পাঠ্যবই বদলে গেছে! কত বড় ধৃষ্টতা আর সাহস এই মূর্খগুলোর, আজ তারা হুমকি দেয় এদেশে নাকি মঙ্গল শোভাযাত্রা করা যাবে না! এই ধৃষ্টতা দেখানোর সুযোগ তাদের করে দিয়েছে স্বয়ং রাষ্ট্র। এবং নিঃসন্দেহ থাকুন, কিছুদিন পর রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করবে এই অসভ্যরা।
গতকাল পাঠ্যবই বদলে দিয়েছে, আজ বন্ধ করতে বলছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, আগামিকাল প্রশ্ন তুলবে ‘নারী নেতৃত্ব ‘ নিয়ে। তার জন্য আপনারা তৈরি তো? এদেশ থেকে বাঙ্গালিত্বের শিকড় উপড়ে ফেলার এই চেষ্টার ফলশ্রুতিতে উগ্রবাদের বিষ আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। তারই একটা বহিঃপ্রকাশ জঙ্গিবাদ। এর থেকে রেহাই পেতে আমাদের সেই মূলের কাছে, শেকড়ের কাছে ফিরে যেতে হবে।
মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটি আবাসিক এলাকায় দু বছর আগেও বৈশাখ উদযাপিত হতো। এখন হয় না। কারণটা ঐ একই। ঐ একই আত্মপরিচয় সংকট এবং জোর করে সেটা চাপিয়ে দেয়া অন্যদের উপরে। আমরা যদি এবারে মঙ্গল শোভাযাত্রা না করি আরও বৃহৎ আকারে, যদি আমরা আগের থেকেও বড় করে উদযাপন না করি পহেলা বৈশাখ, তাহলে পুরো দেশটাই জাপান গার্ডেন সিটির মতো হয়ে যাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপশক্তিকে আমরা আটকাতে পারবো কি?
রমনা বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ করেও পরের বছর কি আটকানো গিয়েছিল পহেলা বৈশাখ উদযাপন? নারীদের উপর যৌন হয়রানি চালিয়েও কি কমানো গিয়েছে নারীদের দৃপ্ত পদচারণা? যায়নি। যাবেও না। এরা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ধর্ম হেফাজত করুক, আমরা বরং প্রস্তুতি নেই মঙ্গল শোভাযাত্রার, অশুভকে সড়িয়ে শুভ শক্তির অগ্রযাত্রার। নির্বোধেরা জানেনা, আমাদের ছবক দিয়ে লাভ নেই, আসছে বৈশাখে আমরা দ্বিগুণ হব।