ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন ‘জঙ্গি’ না হয়

জয়শ্রী দত্ত:

আড়াই বছর বয়েসে সূর্য্যের সবচে’ প্রিয় কার্টুন ক্যারেক্টার ছিল ‘বব দ্য বিল্ডার’ ৷ ওর বাবার টুলস বক্স থেকে হাতুড়ি ,পেরেক নিয়ে ,সাইকেলের হেলমেট তা মাথায় চাপিয়ে ঘরময় ঠোকাঠুকি করতো ৷ ‘বড় হলে কী হতে চাও’ জিজ্ঞেস করলে বলতো বব দ্যা বিল্ডার হবে ,বড় বড় বিল্ডিং বানাবে হেলমেট পড়ে !

ক’দিন পরে ওর মনে বিস্ময় জাগলো সকাল বেলাতে যে বিশাল রিসাইকেল বিনের লরী ট্রাকটা ময়লা নিতে আসে, ওটার বিন ওঠানোর অটোমেটিক ‘ক্ল’ টা কী অসাধারণ এক আশ্চর্য্য ,সব ময়লা নিজে নিজে ট্রাকের ভেতর পড়ে যায়, লরী এলেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে ড্রাইভারটির দিকে তাকিয়ে থাকতো ! সেই দেখে সূর্য্যের খুব ইচ্ছে হতো সে বিন-ড্রাইভার হবে আর সীটে বসে ‘ক্ল’ টাকে ইন্সট্রাকশন দেবে!

আরেকটু খানি যখন বড় হলো ,বয়েস সাড়ে তিন /চারের মতো, তখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিদিন লেটার উইন্ডোর ফাঁক গলে এক গোছা চিঠি পৌঁছে দেওয়া লাল সাদা ইউনিফর্ম পড়া রয়েল মেইলের ডাক পিওনের চাকরিটা সূর্য্যের বেশ মনে ধরেছে , নার্সারির একটা লাল ব্যাগ ক্রস করে কাঁধে নিয়ে ,তার ভেতরে হাবিজাবি কিছু কাগজে আঁকিবুকি করে পোস্ট বানাতো, আর মিছেমিছি মা,বাবা, ঠাম্মার নামে চিঠি লিখে ‘সাইন ফর ডেলিভারি’ সার্ভিসের সিগনেচার নিতো আমাদের সকলের!

একদিন সেই মোহও কেটে যায় ,একদিন বায়না ধরেছে তাকে যেন পুলিশ বা আর্মির কস্টিউম কিনে দেই! তারপর থেকে এতো বছর ধরে তার ‘ডিফেন্সই’ জীবনের লক্ষ্য ছিল৷

একদিন আমি আর ওর ঠাম্মা দুজনে বসে সূর্য্যকে ঘন ঘন ‘এইম ইন লাইফ’ বদলে যাবার কারণ জিজ্ঞেস করলাম ৷
ওর ঠাম্মা জিজ্ঞেস করলো -বাংলাদেশের গ্রামের বাড়িতে বব দ্যা বিল্ডার যে বিল্ডিংব্লক বানিয়ে দেবে বলেছিলো ,তার কী হবে!

বললো – “টু মাচ হার্ড ওয়ার্ক” !

তারপর জিজ্ঞেস করলাম – তাহলে বিন-লরী ড্রাইভার হবার কী হবে?

উত্তর দিলো – “টু মাচ স্টিংকি”।

এইভাবে সাধের পিওনের চাকরিটাও তার অপছন্দের তালিকায় পড়ে গেলো, কারণটা ছিল পিওনকে নাকি বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, এটা সে পছন্দ করে না!

ইদানিং দেখছি পুলিশ বা আর্মি তেও যেতে চায় না আর ! এতো অবসেসিভ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটবার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে কায়দা করে বহু সাধাসাধির পর মুখ খুললেন!

বললো – “লাইফ ইজ টু রিস্কি হিয়ার এন্ড আই এম টু ইয়াং টু ডাই” !
জিজ্ঞেস করলাম – কেন এরকম মনে হলো?
বললো – টিভিতে প্রায়ই দেখায় পুলিশ বা সোলজাররা মিশনে গিয়ে কিল্ড হচ্ছে!

সর্বশেষ খবর পেয়েছি, তার জীবনের লক্ষ্য নাকি লইয়ার হওয়া, তাই গত সপ্তাহে স্কুলের আয়োজিত ক্যারিয়ার প্ল্যান ওয়ার্কশপ এ স্যুটেড বুটেড হয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো!
হঠাৎ জীবনের লক্ষ্য কেন পরিবর্তন -তা জানতে চাইলে বললো – এটা নাকি “পশ (অভিজাত)” ,তাছাড়া আমাদের মতো সেও নাকি চ্যাম্বারে বসতে চায়! আবার এও জানালো, টিভিতে ‘জাজ রিন্ডার ও জাজ জুডি’ রিয়্যালিটি প্র্রোগ্রামগুলি তার ভীষণ পছন্দের!

সূর্য্যের এই সাম্প্রতিক ‘আইনজীবী’ বিষয়ক অকস্মাৎ ভাবনায় আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বেজায় খুশি এই ভেবে যে, এটা যদি সত্যিই ঘটে, আমার বাবার পেশাটাকে আমরা তিন জেনারেশন ধরে রাখতে পারবো হয়তো!

কিন্তু সূর্য্যের উত্তরগুলো আমাদের ভাবিয়েছে! সব উত্তরেই বয়েস অনুযায়ী প্রচণ্ড লজিক আছে ! কিন্তু টিপিক্যাল এশিয়ান অভিভাবকের মতো ওর মাথায় বুদ্ধি হবার সাথে সাথে আমরা কখনোই ‘ডাক্তার ,ইঞ্জিনিয়ার ,ব্যারিস্টার ‘ হবার মতো স্টেরিও টাইপ ‘এইম ইন লাইফ’ এর বোধ চাপিয়ে দিইনি, চাইনিও – সেই যুগ এখন লং গন!

তবুও ভেবে দেখলাম বারংবার লক্ষ্য বদলে ফেলার পেছনে ওর বোধে কাজ করেছে বেশি চারপাশের প্রতিদিনের চরিত্রগুলির কাজের প্রকৃতি ও তার ফলাফল, দৈনন্দিন মিডিয়ার সম্প্রচার আর একেবারে নিজের পরিবারের মানুষগুলির কর্মকাণ্ড!

হয়তো যত বয়স এগোবে ,তার ভাবনাগুলোও পরিবর্তন হবে ,কিন্তু সেই পরিবর্তনে আমাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল চরিত্রগুলোর নেগেটিভ ইফেক্টটাই যদি বেশি কাজ করে, মিডিয়ার বা অন্য রিসোর্সগুলির কন্সট্রাক্টিভ ভূমিকা যদি দিনে দিনে কমে যেতে থাকে, ভায়োলেন্স আর হেট্রেড যদি চারপাশের সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে রাখে, পরিবার ও সার্বক্ষণিক কাছের মানুষগুলি থেকে যদি পজিটিভ এবং মোটিভেশনাল কর্মকাণ্ডের উদাহরণ ও গাইডেন্স না আসে… তবে যেকোনদিন ‘পশ লইয়ার’ হবার লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ‘একজন কিউট জঙ্গী’ হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে জাহান্নামে পা বাড়ানো মোটেও কঠিন বা অপ্রত্যাশিত ফল নয় !!!

সন্তানদের বেড়ে ওঠবার সময়ে তাদের সাথে একান্ত সময় কাটানো, তাদের দৈনন্দিন অনুভূতির ভাগীদার হওয়া , তাদের গঠনমূলক কাজে, সৃষ্টিশীল চিন্তায় ব্যস্ত রাখা, আনন্দময় পরিবেশ দিয়ে বিষণ্ণতা সরিয়ে রাখা, মানবিক ব্যবহারের জন্য প্রশংসা ও অনুপ্রেরণা যোগানো, তাদের বাহ্যিক সাহচর্য অনুধাবন করা, ভালোতে পুরষ্কার ,খারাপে তিরস্কার ইত্যদি অনুষঙ্গ আজকাল ভীষণ জরুরী হয়ে পড়েছে নিজের সন্তানদের ধ্বংসাত্বক পথের হাতছানি থেকে আড়াল করতে। জানি, বলা সহজ, করার জন্যে লেগে থাকাটা পর্বত সম কঠিন, কিন্তু অসম্ভবও নয়।

ভয় হয় আজকাল ,খুব ভয় ! পারবো তো শেষ রক্ষা করতে ! পারিবারিক শিক্ষা , চারপাশের পরিবর্তনশীল অনুষঙ্গ আর ডিজিটাল যুগের মিডিয়া আমার সন্তানকে সুনাগরিক আর প্রাণোচ্ছল মানুষ হতে দেবে তো ?

এটাও ভেবেছি ,সত্যি সারাদিন “ভালো হও ,মানুষের মতো মানুষ হও, এটা করোনা ,ওটা ভালো কাজ নয় …” বলে হাজারটা উপদেশ দিলেও চলবে না ! সবচে’ আগে সন্তানের সামনে নিজেকে সেগুলো করে বা হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার বিকল্প নেই। পরিবার, সমাজ, দেশ জুড়ে অগুনতি পজিটিভ রোল মডেল সৃষ্টি করা দরকার এই বাড়ন্ত সন্তানদের সামনে … সাথে মিডিয়া এবং অন্যান্য সমস্ত রিসোর্স যেমন বই, খেলনা সামগ্রী, কস্টিউম ইত্যাদিও সেসব রোল মডেলদের ভূমিকা বেশি প্রচার করা অত্যন্ত জরুরী …
… Because children never take advice , they just execute examples !!

আমাদের সন্তানদের আমরা বাঁচাতে চাই, ধনী, সফল, স্মার্ট ,বিদ্বান হিসেবে নয় …শুধু একজন প্রাণবন্ত হৃদয়ের সুখী মানুষ হিসেবে !

বিঃদ্রঃ এই লেখার সাথে একমত হতে হবে কথা নেই , তবে অন্য সকলের সাজেশনও আশা করছি কমেন্ট এ। কারণ এই লড়াই আমাদের নয় মাস জঠরে থাকা, সুরক্ষায় জন্ম দেওয়া সন্তানদের বাঁচাবার লড়াই। কোন বিবেচক পিতামাতা চায় না অতি ভালবাসার সন্তানের জন্যে খুঁজে খুঁজে রাখা নিজেদের সবচেয়ে প্রিয়, পছন্দের, গর্বের, পবিত্র নামটি একদিন মুছে গিয়ে একটি ঘৃণ্য ‘জঙ্গি’ নামক নাম নিয়ে জীবনাবসান হোক!

আমি অন্তত চাইনা , তাই একা হলেও শেষতক লড়াই করবো সন্তানকে বাঁচাবার !

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.