নাসরীন রহমান:
পহেলা বৈশাখ এখন আর বাঙালির প্রাণের উৎসবই নয় শুধু, জাতিসংঘের বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাতেও ঠাঁই করে নিয়েছে এটি। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব, বিশ্বের সকল প্রান্তের বাঙালি এই উৎসব পালন করেন হৃদয়ের গভীর আবেগে থেকে। সকল শ্রেণী, ধর্মের মানুষ এই উৎসব একত্রে পালন করেন বলেই এটি সার্বজনীন উৎসবে রুপ পেয়েছে।
বাংলা নববর্ষের একটি ইতিহাস আছে , সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল
হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। ফলে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে অসুবিধায় পড়তে হতো।
খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের
সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।
প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে
রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা।
পহেলা বৈশাখের উৎসবকে ঘিরে বাঙালির উৎসাহ, উদ্দীপনার দিকে লক্ষ্য করলে একটি বৈশিষ্ট্য খুব সহজেই চোখে পড়ে, তা হচ্ছে বাঙ্গালির অসাম্প্রদায়িক মনোভাব; ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ এই উৎসবে শামিল হোন প্রাণের
তাগিদে; এমনকি ঢাকায় চারুকলার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে কেন্দ্র করে প্রচুর বিদেশির উপস্থিতি চোখে পড়ে; এই উপস্থিতি আমাদের পারস্পারিক সহাবস্থান এর দিকটি যেমন শিক্ষা দেয়, তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতেও প্রেরণা দেয়, কেননা এই একটি মাত্র উৎসবে ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে বাঙালি একত্রিত হয় আনন্দে মেতে উঠতে।
পহেলা বৈশাখ আজ যে সার্বজনীন রূপ পেয়েছে তার মূল কারণ হচ্ছে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গী; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য গত কয়েক বছর ধরে সেই অসাম্প্রদায়িকতার উপর ‘ধর্মের খড়গ’ নেমে আসছে প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে; একশ্রেণীর ধর্মীয় গোষ্ঠী এই উৎসবকে হিন্দুস্থানি উৎসব বলে ‘পহেলা বৈশাখ’ এর অনুষ্ঠান বাতিলের পক্ষে
প্রতিবারই দাবি করে আসছেন!
গতবছর ঢাকায় এক মানববন্ধন ও সমাবেশে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখকে ‘ইসলাম বিরোধী’ ও ‘অনৈসলামিক’ আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছিল আওয়ামী ওলামা লীগের একাংশ৷ এ বছরও ‘ইসলামি ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’ পহেলা বৈশাখকে ইসলাম বিরোধী বলে বাতিলের দাবি জানিয়েছে ; এমনকি সরকারি ঘোষণা মোতাবেক প্রতিটি শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে পহেলা বৈশাখ পালনের যে আদেশ তারও বিরোধিতা করেছে সেই কমিটি।
এই ঘটনায় জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে; পহেলা বৈশাখের উপর এ জাতীয় খড়গ এবারই বা গতবারই যে প্রথম, তা নয়; ২০১৫ সালে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী গেট সংলগ্ন এলাকায় নারীদের উপর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছিলো, সেই অজুহাতে গত বছর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নির্দ্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ; কিন্তু এ বছর যখন আবার নিরাপত্তার অজুহাত তুলে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায়’ মুখোশ পরা নিষিদ্ধ করার
কথা বলা হয়, তখন স্পষ্টত বোঝা যায় কাদের খুশি করতে এ আদেশ!
‘পহেলা বৈশাখ’ শুরুর আগেই যখন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে মঙ্গল শোভা যাত্রায় মুখোশ পরা যাবে না’; তখন বোঝাই যায় যা এতোদিন ছিল ইসলামি মৌলবাদীদের নীতি তা এখন রাষ্ট্রীয়
নীতির অংশ হয়ে গেছে!
এর আগেও আমরা দেখেছি , সাম্প্রতিক সময়ে পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তনের নামে সাম্প্রদায়িকটাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে ; গত ‘ অমর একুশের গ্রন্থমেলা ‘য়ও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি , নিরাপত্তার অজুহাত তুলে প্রকারান্তরে ‘নিয়ন্ত্রণ’ ই আরোপ করা হয়েছিল।
‘পহেলা বৈশাখ ‘ আমাদের অসাম্প্রদায়িক হতে শিক্ষা দেয় ; সেই পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যখন বিধি নিষেধ আরোপিত হয় তখন আশঙ্কা জাগে ‘পহেলা বৈশাখ’ তার চিরাচরিত রূপটি হয়তো অচিরেই হারিয়ে ফেলবে, বা ফেলেছে এরই মধ্যে। আদেশ বা নিষেধ প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ততাকে বাধাগ্রস্ত করে ; বাঙালি চিরকাল প্রাণের তাগিদেই পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নিয়েছে, আরোপিত কোনো উৎসবকে নয়, সেই ধারাটিই বরং অব্যাহত থাকুক।