উইমেন চ্যাপ্টার (১৪ জুলাই): হেফাজতের আমীর আহমদ শফীর নারী বিষয়ক সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন আজ উত্তপ্ত। মহাজোটের নেতৃবৃন্দ এই বক্তব্যের জন্য তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা শফীর বক্তব্যের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য বেবী মওদুদ সমালোচনা করে বলেন, তার এই বক্তব্য নারীর অধিকার ও স্বাধীনতাবিরোধী। যারা এ ধরনের কথা বলেছেন, তারা সংবিধান ও আইন লংঘন করেছেন। আমরা তাদের শাস্তি চাই।
আল্লামা শফীকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, তিনি কী নারীদের ঘৃণ্য ও পশু বলে মনে করেন? তাঁর মাকেও ঘৃণ্য বলে মনে করেন? এদেশের হাজার হাজার মেয়েরা চাকুরি করে জিবীকা নির্বাহ করেন। শফী সাহেবের কথা মতো তারা কী চাকুরি করতে গিয়ে জেনা করেন? গার্মেন্টস শিল্পের নারী শ্রমিকরা নিরলসভাবে কাজ করে, তবে কী তারাও জেনা করে? আল্লামা শফীরা দেশকে মধ্যযুগে ফিরে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমরা সেই যুগ থেকে ফিরে এসেছি। তাই এসব পাপীদের আমরা ঘৃণা করি।
কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী শফীর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, নারী সমাজের অপমানের প্রতিবাদ করা একজন নারী হিসেবে আমার নৈতিক দায়িত্ব। আল্লামা শফী ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু আল্লামা মানে আল্লাহ নয়, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ধর্মের নামে নারীদের সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলেছেন। তিনি (আহমদ শফী) নিশ্চয় একজন মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছেন, তাঁরও স্ত্রী ও মেয়ে রয়েছে। সেই নারী সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে জাতির ঘৃণা জন্মেছে। উনি গা ঘিন ঘিন করা বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, বেশিক্ষণ নারীদের দিকে তাকিয়ে থাকলে আহমদ শফীর কী হয়, তা আমি অনুমান করতে চাই না। তাঁর বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে, কেউ আমার গায়ে বমি করে দিয়েছে।
কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগে যখন কন্যা সন্তানকে পুঁতে ফেলা হতো, তখন আল্লাহ নারীদের রক্ষা করার জন্য কোরআনে একাধিক আয়াত নাজিল করেন। অথচ আল্লামা শফী ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের আবারও পেছনের দিকে ঠেলে দিতে চাইছেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিরোধী দল আল্লামা শফীকে এখন ব্যবহার করতে চাইছেন। কিন্তু আহমদ শফীর বক্তব্য অনুযায়ী, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ও তাদের মহিলা সংসদ সদস্যদের আজ জাতীয় সংসদে নয়, ঘরে বসে থাকার কথা।
গত ৫ মে হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞ ও তাণ্ডবের কথা উল্লেখ করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, পবিত্র কোরআন শরিফে আগুন দিয়ে তারা কী ইসলাম রক্ষা করতে চান? ওইদিন শাপলা চত্বরে হেফাজতের বিকাল ৫টা পর্যন্ত থাকার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকে পুরো ঢাকা শহরকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়া হলো, নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হলো। হেফাজতরা সেদিন যেভাবে সংহারে নেমেছিলেন, কোরআন শরিফ- জায়নামাজে আগুন দিয়েছেন- আল্লাহ তা সহ্য করবে না।
কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, একজনের উপার্জনে সংসার চলে না। সন্তান না খেয়ে থাকলেও মা চাকুরি করতে পারবেন না। সন্তানের মুখে বিষঢেলে মা আত্মহত্যা করবেন- এটাই কী চান শফী সাহেবরা। তিনি বলেন, ’৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময় রংপুরে শুধুমাত্র পেটের দায়ে যখন বিপুল সংখ্যেক নারী এফিডেফিট করে দেহব্যবসা শুরু করলেন, তখন আল্লামা শফী কোথায় ছিলেন? জেনারেল জিয়া যখন প্রিন্সেস লাকী ও জরিনা খানদের নাচালেন, মদ-জুয়ার লাইসেন্ম দিলেন- তখন কেন নিশ্চুপ ছিলেন? বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ কেন করেননি? তখন কেন শফী সাহেবরা প্রতিবাদ জানিয়ে একটাও বিবৃতি দিলেন না? মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ মা-বোনদের সম্ভ্রম কেড়ে নেয়া হয়েছে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। অনেক নারী অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। ক্যাম্পে মেয়েদের আটকে রেখে সম্ভ্রমহানি করা হতো। তখন গোলাম আযমরা ফতোয়া দিয়েছিলেন- যুদ্ধের সময় জেনা করা জায়েজ। বলেছিল মেয়েরা গণিমতের মাল। একই ধরনের কথা আজ বলা হচ্ছে।
নারীদের অপমান করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে মতিয়া চৌধুরী বলেন, জেনে শুনে অন্যায় করার জন্য নিশ্চয় আল্লামা শফীদের একদিন নারী সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে দিতে হবে। আল্লামা শফীর যে কুরুচিপূর্ণ-অশ্লীল বক্তব্য দিয়েছেন, তা নারী সমাজ প্রত্যাখ্যান করবে। নারী সমাজের পাশে আমরা ভাইদেরও (পুরুষ) চাই। নারী-পুরুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লামা শফীদের ধিক্কার ও ছিঃ ছিঃ জানাবে।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মহানবীর বাণী তুলে ধরে বলেন, নবীজী বলেছেন, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। অথচ আল্লামা শফী আজ আল-কোরআনের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এটা ষড়যন্ত্র। এ সময়ে এ নিয়ে নীরব থাকা যায় না।
ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি আল্লামা শফী’র বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন একজন নারী বিবি খাদিজা। আর জেহাদেও প্রথম শহীদ হয়েছিলেন একজন নারী বিবি সুমাইয়া। মা ফাতেমা নবীজীর (সা.) সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নারী সমাজের বিশাল অবদান রয়েছে। এদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও স্পীকার তিনজনই নারী। বাংলাদেশের নারীরা আজ হিমালয় জয় করছে। নারীর ক্ষমতায়ন আজ সারাবিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, ইসলাম ধর্মে কুৎসা রটনা করে নারীর অবমাননা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আল্লামা শফী নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে নারী সমাজের সম্মানহানী করেছেন।
তিনি বলেন, আল্লামা শফীর বক্তব্য সংবিধান ও সব ধরণের আইনবিরোধী। যে নেত্রীর উস্কানী শুনে নারীদের আপমান করেছেন- আপনার ক্ষমা নেই। দেশবাসীর সামনে শফী আহমদকে অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। নইলে তার বিচার হবে। আর যারা আহমদ শফীদের যারা অর্থ-অস্ত্র ও মদদ দিচ্ছে তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করবে দেশের জনগণ।
সরকারি দলের আরেক সংসদ সদস্য নাট্যাভিনেত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম বলেন, বিএনপির নারী সংসদ সদস্যরা সংসদে হৈ চৈ করে আহমেদ শফীর নোংরা-অসভ্য-জঘন্য বক্তব্যকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন জানাচ্ছেন। এতে নারী হিসেবে আমি ভীষণ লজ্জ্বিত, ঘৃণা জানানোর ভাষা নেই। তিনি বলেন, পবিত্র ইসলাম ধর্মে নারীকে পুরোপুরি সম্মান দিয়েছে, অথচ শফী সাহেব নারীকে অসম্মান করে সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। নারী সমাজকে আঘাত করেছেন। ’৯৩ বছর বয়সী আহমদ শফীর কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের বিরুদ্ধে দেশের নারী সমাজ আজ জেগে উঠেছে। যারা পবিত্র মসজিদে অগ্নিসংযোগ করেছে, কোরআন শরিফ পুড়িয়েছে- তারা কীভাবে ইসলামের রক্ষক হতে পারে? জাতির কাছে এর জন্য আল্লামা শফীকে ক্ষমা চাইতে হবে।
আহমদ শফীর নারীবিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদে সরকারি দলের নারী সংসদ সদস্যদের এমন বক্তব্যের সময় বিরোধী দলীয় সদস্যরা হৈ চৈ করে প্রতিবাদ জানান। এ বিষয়টিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বেবী মওদুদের বক্তব্যের সময় বিরোধী দলীয় নারী সদস্যদের অট্টহাসিই প্রমাণ করে তারা হেফাজত আমীরের নোংরা ও অশ্লীল বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। তাদের আচরণই প্রমাণ করে তাদের মদদেই আল্লামা শফীরা নারী সমাজকে অসম্মান করে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন। নারী হিসেবে তাদেরও শফীর বক্তব্যের বিরুদ্ধের সোচ্চার হতে হবে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সোচ্চার হলেও বিরোধী দলীয় নেতা কেন এখনো সোচ্চার হননি- সেটা প্রশ্ন।
তিনি বলেন, কেবল নারী সমাজই নয়, শিশু কন্যাদেরও অসম্মান করেছেন শফী। তিনি বলেছেন, নারীরা পুরুষ শিশুদের দেখভাল করবে। সেখানে নারী শিশুদের কথা বলা হয়নি। অথচ দেশের সংবিধান নারী শিশুদেরও সমান অধিকার দিয়েছে। সুতরাং তার এই বক্তব্য সংবিধানবিরোধী। এজন্য তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে চুমকি বলেন, মনে করবেন না আমরা ভীত হয়ে গেছি। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জিতেছেন বলে মনে করবেন না আগামীবার জাতীয় সংসদেও জিতবেন। বাংলাদেশের মানুষ এত বড় ভুল করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা আবারও দেশ গড়ে তোলার সুযোগ পাবো।
তিনি বলেন, বারবার মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে নারীদের পিছনের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে বিরোধী দল। দেশবাসীরা আর দেশকে আফগান-তালেবানী শাসনে ফিরে যাবে না, উন্নয়নের পক্ষেই থাকবেন। এদেশের নারীরা আফগান-তালেবানের রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না, প্রতিরোধ গড়ে তুলেই এসব ষড়যন্ত্রকারীদের রূখে দেবেই। অন্যায়-মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে নারী সমাজ রুখে দাঁড়াবেই।
সংরক্ষিত আসনের সদস্য বিএনপির সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া বলেন, আল্লামা শফী একজন আলেম মানুষ। এই সরকারাই তাকে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ নানা পদপদবি দিয়ে সম্মানিত করেছে। অথচ তার বিরুদ্ধেই এই সংসদে কেন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে- সেটা আমরা বুঝছি না।
তিনি বলেন, আল্লামা শফী’র নামে যে ভিডিও ছাপা হয়েছে, তা মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে নিজেই বলেছেন আল্লামা শফী। আহমদ শফী যে ১৩ দফা দিয়েছেন, তাতে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকার সমর্থিত মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে তার বক্তব্য বিকৃত করে সংসদে বক্তব্য দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে। আহমদ শফীর নামে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ১৩ দফার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে গার্মেন্টস নারী শ্রমিক সমাবেশ সম্পূর্ণ ফ্লপ হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।
হেফাজতের ১৩ দফা বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, তদন্ত করে দেখান ১৩ দফার কোথায় কোথায় ইসলামের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ওয়াজ মাহফিলের অনুমতি দেয় না, উলঙ্গ নৃত্যের অনুমতি দেয়। ৫ মে হেফাজতের সমাবেশ চলাকালে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশ দিয়ে হেফাজত কর্মীদের ওপর হামলাসহ তাদের জবাই করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না। শাহবাগে রাস্তা দখল করে কাউকে মাসের পর মাস অবস্থান করতে দেওয়া হবে, আর হেফাজত শাপলা চত্বরে অবস্থান নিতে গেলে তাদের ওপর হামলা চালানো হবে- এটা ঠিক নয়।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, সংসদে একজন উচ্চকন্ঠে বললেন, অতীত নিয়ে কথা বলবেন না! তাঁকে প্রশ্ন অতীত ছাড়া কী বর্তমান হয়? তিনি বলেন, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রতি আঘাতকারীকে রাষ্ট্র ছাড় দিতে পারে না। জাতীয় সংসদে বিষয়টির ফয়সালা হওয়া দরকার। বিষয়টি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। নারীর অবমাননা সহ্য করা যায় না। যতই ষড়যন্ত্র-মিথ্যাচার করা হোক, বাংলাদেশকে আমরা কোনভাবেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিকে যেতে দেব না। নারীর অগ্রগতি কেউ রোধ করতে পারবে না। বাঙালিকে আবার একাত্তরের মতো সন্ত্রাস, মিথ্যাচার, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে হবে।