নাসিব নিতু:
সাওম, আমাদের একমাত্র সন্তান। চার বছর বয়সী সে। সকাল আটটা থেকে ওর স্কুল শুরু হয়ে শেষ হয় দশটায়। আমিই ওকে স্কুলে দিয়ে আসি। কর্মস্থল দূরে হওয়াতে তার বাবা আগেই অফিসে বেরিয়ে যান। আমার অফিস দশটায় শুরু হয়। ছেলেকে আনার কেউ নেই, তাই কস্ট করে আমিই তাকে আনি। তারপর অফিসে যাই। প্রায় দিন অফিসে দেরি হয়ে যায়। তাই খুব দেরী হলে মাঝে মাঝে গেটের দারোয়ান কে বলতাম বাবুকে বাসায় রেখে আসতে। একদিন হঠাত মনে হল, বাচ্চারা এভাবেই তো নিপীড়নের স্বীকার হয়। যাকে রেখে আসতে বলছি সে তো আমার আপনজন না; পরিচিত মাত্র। নিজেকে মনে মনে চপেটাঘাত করেছি আর ভেবেছি আমার শিক্ষা আর সচেতনতার মুল্য কি থাকলো? যাইহোক আমি হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছি কোন অঘটন ঘটার আগেই, আপনি সচেতন তো?
আসলে আমার ভুমিকার কথাগুলো ছিলো একটা নির্দিষ্ট ঘটনার উপরে ফোকাস করার জন্য। ইদানিং একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনি “শিশু যৌন নিপীড়ন বা নিপীড়ক”।“ চাইল্ড সেক্সুয়াল এবিউজ” বর্তনান সময়ে পুরো বিশ্বের একটা জ্বলন্ত সমস্যা। ২-৬২% মেয়ে শিশু আর ৩-১৬% ছেলে শিশু “sexual abuse” এর শিকার। বাংলাদেশেও এই সমস্যা প্রবল।
আসলে এই ব্যাপারে আমরা কতটা জানি বা সচেতন? আমি আজকে শিশু নিপীড়ন প্রতিহত করতে মায়ের ভুমিকা কতটুকু তাই বলবো। তার আগে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা নিয়ে বলি-
১) অপরিচিতরাই নিপীড়ক হয়।
২) ভালো পরিবারে এমন ঘটে না।
৩) শিশুটি ভুল বুঝেছে।
৪) শুধু খারাপ লোকেরা বাচ্চাদের হেনস্তা করে।
৫) নিপীড়ক শুধু পুরুষই হয়।
৬ ) মেয়ে শিশুরাই শুধু এর শিকার হয়
আসলে এই ধারণাগুলো কতটুকু সত্যি?
- শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিপীড়নের শিকার হয় তাদের পরিচিতদের মাধ্যমে।
- বর্তমানে সমাজের সব শ্রেণীতেই এই সমস্যা প্রকট।
- অনেক ভালো লোক, সংসারী, পাঁচ ওয়াক্তের নামাজী, কলেজের অধ্যক্ষ বা ব্যাংকার, সমাজের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন লোকের দ্বারাও সংঘটিত হয়।আসলে এই নোংরা প্রবৃত্তিটা সেইসব মানুষ বহন করেই চলে।এর জন্য সামাজিক অবস্থান মুখ্য নয়।
- যৌন নিপীড়ক শুধু পুরুষ হয় এ ধারনাও ভুল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়ত পুরুষ কিন্তু নারীরাও যৌন নিপীড়ন করে শিশুদের।
বিবিসি বাংলায় ২০১৩ সালের ৮ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদ-“বাংলাদেশে শিশু অধিকার কর্মীদের ভাষ্যমতে, দেশটির শতকরা নব্বই ভাগ শিশুই পারিবারিক গণ্ডিতে ধর্ষণ থেকে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শসহ নানা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে।“
যে শিশু নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তার নাজুক মনে এর প্রভাব পড়ছে কঠিনভাবে। নিপীড়নের কারণে সৃষ্ট শারীরিক ক্ষত হয়তো সময়ের ব্যবধানে ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু মানসিক ক্ষত কি পূরণ হবে? আক্রান্ত শিশু হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে, এমনকি অসুস্থ হয়ে পড়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে। সেইসাথে কোন ভাবে যদি শিশুটি STD (sexually transmitted diseases) দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে তো কথাই নেই। এই যন্ত্রণা তাকে বহন করতে হবে আমৃত্যু।
মায়ের সময়: একজন মা হিসেবে আপনি আপনার সন্তান কে যতটা বুঝবেন তা আর কারও বোঝার কথা না। আপনার শিশু সন্তানকে সময় দিন পর্যাপ্ত। যদি আপনি চাকরিজীবী হন তাতেও সমস্যা নাই। prefer quality to quantity. বাচ্চাকে আপনি কতটা বোঝেন সেটা ব্যাপার না, আপনার বাচ্চা আপনাকে কতটা বোঝে এটাই মুখ্য। সে আপনাকে সব খোলাখুলি বলতে পারছে কিনা সেটা দেখুন। মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধুত্ত্বপূর্ন সম্পর্কের বিকল্প নেই।
কথার গুরুত্ব: আপনার শিশুর প্রতিটা কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করুন। এর জন্য রকেট সাইন্স তো শিখতে হবে না। দরকার আপনার গুরুত্ব আর সচেতনতা। আপনার শিশু একই বিষয়ে যদি বারবার কিছু বলে সেটাকে গুরুত্ব দিন, এবং সেটা নিয়ে খোঁজ করুন,গোপনে বা প্রকাশ্যে নজরদারি করুন। আপনার শিশু যদি নির্দিস্ট কোন ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়া তে ভীত হয় বা আপত্তি জানায় ; উড়িয়ে দেবেন না। ঘটনার পেছনের কারন জানার চেষ্টা করুন। এক্ষেত্রে বাচ্চাটিকে জোর না করে কৌশলী হন ।সে বা তার কথা আপনার কাছে যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা তাকে বুঝতে দিন। এক্ষেত্রে একটা ঘটনা না বলে পারছিনা।-
“আমি যখন স্কুলে পড়ি –ক্লাশ টু বা থ্রি হবে।আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন। উনি ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের কে বেশী আদর করতেন এবং তার সেই আদরের ধরণে এমন বিরক্তিকর কিছু ছিল হয়তো ;যে কোন মেয়ে শিক্ষার্থী তার কাছে যেতে চাইতনা। আমাকে যেন এমন আচরণের শিকার হতে না হয় তাই আমি আমার মাকে ব্যাপারটা জানাই। (ছোট ছিলাম তাই বোধটা আমিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো।)আমার মা এইসব ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন এবং আমি যখন খুব ছোট তখন থেকেই আমাকে বলতেন “unusual touching” এর ব্যাপারে, যাইহোক মা ব্যাপারটা স্কুল কর্তৃপক্ষ কে জানান এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি বিবেচনা করেন এবং সেই শিক্ষক কে সতর্ক করে দেন। এর বেশ কিছুদিন পর সেই শিক্ষক তার চাকরী পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যান।“
আমার মা আমার কথা শুনেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। আপনি আপনার সন্তানের প্রতিটা কথা শুনুন।দিনশেষে ঘরে ফিরে একঘন্টা বসুন তার সাথে ;নিজের কথা শেয়ার করুন -ওকে শেয়ার করতে দিন ওর কথা।
অনুভব করুন: আপনার দুষ্টু বাচ্চা হঠাত করেই চুপচাপ হয়ে গেছে।খেলতে চাচ্ছেনা।,পছন্দের খাবারে নেই রুচি। অল্পশব্দেই চমকে উঠছে বা খিটখিটে হয়ে গেছে বা এমন কিছু যা তার স্বভাবের সাথে যায়না। দেরি করবেন না, কারণ অনুসন্ধানে নেমে পড়ুন। জানেন তো মায়েদের চেয়ে সন্তানের জন্য ভাল গোয়েন্দা আর নেই!
পারিবারিক পরিবেশ আর বইঃ শিশুর জন্য পরিবারকেই একটা বিনোদোনের ক্ষেত্র তৈরী করুন। পারস্পরিক সম্পর্ক এমন করুন, যেন শিশু বাইরে আশ্রয় না খোঁজে।সুযোগসন্ধানীরা এইসব কিছুই কাজে লাগায়। খুঁজে বের করে আপনার শিশুর দূর্বল জায়গাটি। আপনার শিশুর একাকিত্ত্ব কেউ যেন পুঁজি করতে না পারে। কর্মজীবী মায়েরা শিশুর বন্ধু হিসেবে বেছে দিন বই কে। আপনি নিজে বই পড়তে আগ্রহী না হতেই পারেন-কিন্তু আপনার শিশুর নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে উদ্বুদ্ধ করুন বই পড়তে। যার বন্ধু বই, সে বাহিরে বন্ধু খোঁজে না এই কথা টা মনে রাখবেন।
অবশ্য করণীয়: শিশু কারো দ্বারা যেন নির্যাতনের স্বীকার না হয় সে জন্য আপনার আরো কিছু কর্তব্য আছে।
১) শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে তাকে কখনো উলঙ্গ রাখবেন না। কারো সামনে তো নয়ই ,একা আপনার সামনেও না। তিন বছর বয়স থেকে তাকে একটু একটু করে বুঝতে দিন;তার স্পর্শকাতর অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ কোন গুলো আর সে গুলো কারো সামনে প্রকাশনীয় নয়।কেউ যদি এসব বিষয়ে তাকে অপ্রীতিকর কিছু বলে তা যেন সে আপনাকে জানায়।
২) শিশুকে না বলতে শেখান। তার অপছন্দনীয় যেটা ,সেটা যেন সে না বলতে পারে।শিশুকে সাহসী হতে সাহায্য করুন। শিশুর মতামতের মুল্যায়ন করলে শিশুর মধ্যে এই বোধ তৈরী হয়।

৩) কোন আত্মীয় বা পরিচিত কারো কাছে যেতে শিশু অস্বীকৃতি জানালে তার কারণ আগে জানুন। শিশুকে জোর করবেন না। মা হিসেবে শিশুর মনের অব্যাক্ত কথা ধরতে পারাটাই আপনার সফলতা। মনে রাখবেন ,নিপীড়নকারীদের মধ্যে আপন নানা-দাদা,চাচা,খালা-খালু,বন্ধু, প্রমুখ নিকটাত্মীয়ও বাদ নেই। আবার শিশু অতিমাত্রায় কারো ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে কিনা,বা একজন কে খুব গুরুত্ত্ব দিচ্ছে কিনা তাও দেখুন।
৪) শিশু কাকে বা কাদের বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করছে তা লক্ষ্য করুন। তার বন্ধুদের কোন ছুটির দিনে তাদের বাবা-মা সহ আসতে বলুন বা আপনি যান তাদের বাসায়। এতে করে শিশুর বন্ধুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ সম্পর্কে হয়তো কিছু ধারণা হবে আপনার। একটু অসুবিধা হয়তো হবে, কিন্তু আমরা সব সামলে নিতে পারি দেখেই তো আমরা আধুনিক মা ,তাইনা? আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সজাগ করুন।
৫) শিশুকে যদি ড্রাইভার বা অন্য কেঊ স্কুলে আনা নেওয়া করে, সেক্ষেত্রে সেই ব্যাক্তির আচরণ কি রকম আপনার শিশুর প্রতি লক্ষ্য করুন। প্রায় কি স্কুলে যেতে বা বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছে। বা আপনার শিশু ঘুরতে যেতে চেয়েছিল বা খেলনা কিনতে গিয়েছিল বলা হচ্ছে? অযথাই কেউ কি শিশুকে উপহার সামগ্রী দিচ্ছে? শিশুর ব্যাপারে খুঁটিনাটি সব বিষয়ে খেয়াল করুন।
৬) শিশুকে স্পর্শ চিনতে শেখান। স্নেহের আর কামনার স্পর্শের ফারাক যেন সে নিজেই করতে পারে।
নিপীড়নের শিকার শিশুরা আত্মগ্লানী আর লজ্জা দ্বারা নির্যাতিত হয়। তার মনে হতে থাকে সব কিছুর জন্য সেই দায়ী। সে মুখ ফুটে যদি কাউকে কিছু বলতে না পারে তার পরিনাম আরো ভয়াবহ। বয়সের সাথে সাথে হয়ত সে মাদকাসক্তও হয়ে পরতে পারে। তাই শিশুকে বলতে সাহায্য করুন সর্বাগ্রে।
আপনার সচেতনতা আর সতর্কতা আপনার শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কর্মজীবি বা গৃহিণী যাই হন না কেন দিনের নির্দিস্ট একটা সময় বাচ্চার জন্য বরাদ্দ রাখুন। হাসুন, গল্প করুন, খেলুন আর আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী হতে শেখান। আপনি হয়তো ভীরু, কিন্তু আপনি নিশ্চই আপনার সন্তানকে ভীরু হতে শেখাবেন না। আপনার সন্তানের দায়িত্ব আপনারই।আপনি যা পারবেন তা আর কেউ পারবেনা। কোন অভিজ্ঞতাই মা সন্তানের সম্পর্কের সমকক্ষ নয়। ভালো থাকুন আর ভালো থাকতে শেখান আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে।