মাতৃত্বের শরীর নিয়ে নাক সিঁটকানো কেন?

সাদিয়া অন্তরা:
আচ্ছা, আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, চোখ বন্ধ করে আপনার জীবনে যারা আছেন, তাদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর নারী কে? উত্তর কী হবে?
জানি বেশীর ভাগ মানুষ বলবে, তার মা। আসলেই আমাদের কাছে আমাদের মা সবচেয়ে সুন্দর। যতোই সাদামাটা হোক কেউ তার মা কে বলে না মা তুমি দেখতে পচা। চিন্তাও করা যায় না। মায়ের মতো কেউ হয় না। 
যাই হোক আজ আমাকে আমার এক পরিচিত একজনের সাথে কথা বলছিলাম। তার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে সে আমাকে বললো যে সে তার স্ত্রীর প্রতি খুশি নয়। কারণ দুইবার মা হওয়ার কারণে তার স্ত্রী নাকি বেশ মোটা হয়ে গিয়েছে, দেখতে নাকি অনেক বয়স্ক লাগে।
আমি এতো অবাক হয়েছি যে কী বলবো। এই লোকটি এক সময় আমার শিক্ষক ছিলো, আর আমার খালাতো বোনেরও শিক্ষক, যেহেতু পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু সে কারণেই আমি ফোন দিয়েছিলাম। আর যেহেতু দূরে থাকি, আমি স্বভাবতই তার পরিবারের কুশলাদি জিজ্ঞেস করছিলাম। সে খুব গর্ব ভরে তার ছেলেদের কথা বলছিলো যে কতো বড় হয়েছে, একজন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে ইত্যাদি।
কিন্তু যেই স্ত্রীর প্রসঙ্গ আসলো তার এই কথা! তার প্রতি আমার সব সম্মান কোথায় যেন ধাক্কা খেলো। তার স্ত্রীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, মেয়েটা অনেক সুন্দরী, আমাদের স্কুলেই পড়তো এবং আমাদের দুই কি তিন ব্যাচ জুনিয়র ছিলো। তার কথা যখন এমন তাচ্ছিল্য ভরে এই লোকটা বললো যে মা হওয়ার কারণে তার শারীরিক যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে সে অসন্তুষ্ট। আমি অবাক হয়ে গিয়েছি।
একজন মেয়ে যখন মা হয় তখন তার শারীরিক পরিবর্তন আসবেই। সে মোটা হবে, তার শরীরে পানি আসবে, তার কোমল চামড়ায় দাগ পড়ে যাবে, সে কালো হবে। তার শরীরে বাচ্চা জন্ম দেয়ার চিহ্ন পড়ে যাবে। দগদগে কাটা নিয়েও সে হাসিমুখে নিজের বাচ্চাকে কোলে তুলে নিবে। তারপর বাড়িতে ফিরে সেই নবজাতকের জন্য সারা রাত জেগে থাকা, খাওয়ানো থেকে শুরু করে তার প্রস্রাব, পায়খানা পরিস্কার করা সবই করতে হয়, সেই সময় নিজের প্রতি যত্ন নিতে অনেকেই পারে না। সম্ভব হয় না। ফলে বয়সের ছাপটাও হয়তো আগেই চলে আসে। সে এগুলো নিয়ে চিন্তিতও থাকে না। কারণ তার সব থেকে খুশির যে স্থান তার সন্তান, সে তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
কিন্ত কিছু পুরুষের তখন হা -হুতাশ শুরু হয়, আমার বউ কেন মোটা হলো, কেন বয়স্ক লাগছে, আমি তো এখনো জোয়ান, আমার কী হবে গো! মানে আসলেই!
এত নীচ মানুষ হয় কি করে!
আরে যে সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে আপনার স্ত্রীর আজ বেহাল(!!) অবস্থা সেটা কি আপনার সন্তান না? আপনি তো বুঝতে পারেননি নয় মাস একজন মানুষকে নিজের পেটের মাঝে বড় করা মানসিকভাবে আনন্দদায়ক হলেও, সেটা কোন ভাবেই শারীরিকভাবে আনন্দদায়ক নয়।
আর জন্ম দেয়ার পদ্ধতি বা তার পরবর্তী জীবন ও  যে শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, তা সব ব্যাথারই উদ্রেক করে। কিন্তু তার পরেও সে হাসি মুখে আবার তার প্রাত্যহিক কাজ করে আপনার জন্য, আপনাদের সন্তানের জন্য। আর তার এতোটুকু পরিবর্তন এখন আপনার মানসিক অশান্তির কারণ!
আপনার মা মোটা, দেখতে কালো, বয়স্ক, শুনতে খারাপ লাগছে না! তেমনি আপনার স্ত্রীও একজনের মা, আপনার সন্তানেরই মা, তাই তার ব্যাপারে খারাপ কথা বলে (আড়ালে আবডালে বা সামনা সামনি) নিজের রুচির পরিচয় দিবেন না আর একজন মায়ের অপমান করবেন না।
টিভিতে নায়িকাদের স্লিম ট্রিম দেখে অনেকের হা -হুতাশ আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চিন্তা করবেন না, তারা মা হলে তাদের অবস্থাও এমনই হবে। এখন অনেকেই হয়তো বলবে, কই না তো, নায়িকারা মা হওয়ার এক থেকে দুই বছরের মাঝেই আবার কতো সুন্দর হয়ে যায়। তাদের মতো কী আপনার স্ত্রী তার নিজের পিছনে সময় বা টাকা ব্যয় করে নাকি তার নাক সিঁটকানো পতিদেব আর সন্তানের পিছনে করে!! উত্তর আপনার জানাই আছে।
আর নায়িকাই কেন হতে হবে? আপনার স্ত্রী যদি এতো শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তনের মাঝেও আপনার সাথে আপনাদের সন্তানের সাথে সুখী হতে পারে,তাহলে আপনি কোন গ্রহ থেকে আসছেন যে আপনি এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারবেন না!!!
মেয়েরাই একসময় মা হয়, কিন্তু কোনো মেয়ে জন্ম থেকেই মা হওয়ার কষ্ট বা ত্যাগ কেমন সেটা জেনে বড় হয় না।তাই তার এই সময়টাতে পাশে থাকুন,তাকে ভালোবাসুন,তাকে সাহায্য করুন যাতে সে নিজের জন্য কিছুটা হলেও সময় বের করতে পারে।আর তার মাঝে আসা পরিবর্তনকে সম্মান করুন, দেখবেন তার মতো সুন্দরী আর কেউ নেই।
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.