নাসরীন রহমান:
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’তে তাদের এতো আপত্তি কেন? এই কারণেই যে, ‘নববর্ষ’ বাঙ্গালির সার্বজনীন উৎসব? বাংলাদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি, সমতলের সকল মানুষ একত্রিত হয়ে প্রাণের উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন করে; সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এই ঐক্যই চায় না; এটা তাঁদের অপছন্দের।
ঐক্য মানেই শক্তি; তারা ঐক্য চায় না, তারা চায় এই দেশের মানুষের মাঝে বিভেদ গড়ে উঠুক; তাই ধর্মের নামে বিভেদের দেয়াল তুলে দিতে চায় তারা; আর তাই তো বলে, ‘মুসলমানদের দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা চলবে না’!
কী চলবে, আর কী না চলবে, তারা বলার কে? দেশটা কি একা তাদের? শুধু ‘মুসলমানদের’? তা অবশ্য তারা বলতেও পারে, কারণ ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ যেখানে ‘ইসলাম’। মানে এই রাষ্ট্রের একটা ধর্ম আছে। যে ধর্মের বলে এই রাষ্ট্র ঈদ করে, রোজা রাখে, কুরবানি দেয়। তাহলে অন্যরা যা করে, তা রাষ্ট্রধর্মবিরোধী?
আজ ”ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’ দাবি করে, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের নির্দেশ দিতে; এতো সাহস তারা পায় কোথায়? পায়, কারণ এর আগে তাদের দাবি পূরণের বাস্তবতা থেকেই তারা নতুন নতুন দাবির তালিকা নিয়ে বসেছে!
যখন পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তনের নামে সাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রবেশ ঘটানো হয়, তখনই বোঝা গিয়েছিল, সবেমাত্র শুরু, এর শেষ কোথায় কে জানে!
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘পহেলা বৈশাখ’ পালনের আদেশ যেমন নিয়ন্ত্রণ আরোপ, তেমনি যখন বলা হয় ‘মুসলমানদের দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা চলবে না’ তখন এটাও শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, নির্যাতনের পর্যায়ে পরে, মানসিক নির্যাতন!
উৎসব পালন করে মানুষ প্রাণের তাগিদে, আদেশের ব্যাপার ঘটলে তখন সেখানে আর প্রাণের স্বত:স্ফূর্ততা থাকে না; ব্যাপারটি হয়ে যায় আদেশ পালন, আজ্ঞা পালন মাত্র! তাই আদেশ, বা নিষেধ নয়, বাঙালিকে তাঁদের প্রাণের তাগিদে ‘নববর্ষ’ পালন করতে দেওয়া হোক, যেমনটি এতোকাল পালন করে এসেছে বাঙালি।
তাছাড়া ‘মুসলমানদের দেশ ‘ বলার মাঝে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর একটা প্রচ্ছন্ন হুমকিও থাকে। এটা ‘ মুসলমানদের দেশ’ এই কথা বলার মাধ্যমে এটাই বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে এই দেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের জন্য না, বা তাদের দেশ না! কাজেই প্রতি বছরের মতো জাঁকজমক আর উৎসব মুখরতার মধ্য দিয়েই পালিত হোক পহেলা বৈশাখ আর মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা ইউনেস্কো এবার বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে চিহ্নিত করেছে। এই ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখতেই হবে। হবেই।