একা থাকতে যোগ্যতা লাগে  বাহে – ২

কামরুন নাহার:

এই শহরে আমি ২০১০ এর মার্চ থেকে একদম একা থাকি। অনেকেই জানতে চায় ভয় করে না আপনার? আমি একটাই কথা বলি, ‘আমি মানুষ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না’। এই শহরে একা থাকায় আমার সবচেয়ে ভয়ের কারণ মানুষ। এই সাত বছরে আমার আপন জনরা ‘বিয়ে কর’ এটা বলা ছাড়া ‘তুই কেমন আছিস, কিছু লাগবে কীনা, কিভাবে সব একলা ম্যানেজ করিস’ এসব কোনদিন জানতে চায়নি।

আমার জ্বর এলে কে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, রান্নাটা কে করে, কে সেবা করে, বাজার কে করে দেয় – কেউ কোনদিন জানতে চায়নি। আমার আপন জনরা আমায় টিপ্পনী কাটে, ‘আমার বয়স হয়ে গেছে, তাই কেউ বিয়ে করছে না‘; কেউ কেউ বলেছেন, ‘কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে একা থাকে না’; আমার নিজের রক্তের লোকজন আমায় বলেছেন, আমি যেহেতু একলা থাকি, আমি যাতে জীবনের সব সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে খুব ‘লো প্রোফাইল’ জীবনযাপন করি, কারো সাথে যাতে না মিশি। আমার মতো বন্ধুহীন লো প্রোফাইল জীবন কেউ যাপন করে না। আমার জীবনে বন্ধু বলতে আমার ছাত্রছাত্রীরাই, যাদের বন্ধুত্ব নির্মল, নিষ্পাপ, আর আমার বেঁচে থাকার প্রেরণাও বটে।  

‘একা থাকতে যোগ্যতা লাগে বাহে’ শিরোনামে আগের লেখাটা প্রকাশের পর সমাজের নানান স্তরের মানুষের কাছ থেকে নানান রকম প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কেউ কেউ আমায় দেবী বানিয়ে ফেলেছেন, কেউ  বিয়ে করতে চেয়েছেন, কেউ এই লেখা নিয়ে টিপ্পনী কেটেছেন, কেউবা আবার নতুন করে আমার সাথে শোয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আমার পরিচিত অনেকেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমার অনেক ছাত্রী বিয়ে না করে আমার মতো জীবনযাপনের কথা ভাবছে, আর যারা একা থাকেন তারা সাহস পেয়েছেন। এই এক লেখা দিয়ে আমি রাতারাতি কাউন্সেলর হয়ে গেছি। নানানভাবে নানান জনকে ফোনে সমস্যার সমাধান দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি।

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, আমার সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। আমার বাড়ির মালিক এবং ক্ষেত্র বিশেষে আমার খুব আপনজনরা ‘বাসায় স্টুডেন্ট আসতে পারবে না’ এই গান গেয়েই যাচ্ছে কানের কাছে। মোদ্দা কথা এই লেখার ম্যাসেজ যাদের কাছে পৌঁছানো দরকার ছিল, তাদের কাছে পৌঁছায়নি। তারা আমার লেখার এন্তার প্রশংসা করেছেন, কিন্তু দিনশেষে তারা একটাই কথা উচ্চারণ করেছেন, ‘বিয়েটা করো, মেয়েদের একা থাকা ঠিক না’, ছেলেদের তবে একা থাকার বৈধতা আছে! বেশ! সব সমস্যার সমাধান তাহলে বিয়েতে!

তথাকথিত শিক্ষিত যারা এই বিষয়টা নিয়ে টিপ্পনী কেটেছেন, এই লেখার মর্মার্থ বোঝেননি, তারা তাদের অত্যাচার আমার উপর বহাল রেখেছেন। পেটভরা বিদ্যা নিয়ে এখনও মূর্খই আছেন তারা। আই ফিল পিটি ফর দেম। এসব জ্ঞানপাপীদের দিয়ে দেশ মদের বিক্রি আর ধর্ম ব্যবসা বাড়ানো ছাড়া কী করবে? এইসব লোকজনই ঘরে বউ রেখে কোথায় কোন ফ্ল্যাটে অবিবাহিতা নারী আছেন, অফিসের কোন সহকর্মীটি হট এন্ড বিউটিফুল; কোনো চাচাতো দেবর ফ্রি আছেন কীনা, মেয়েকে পড়াতে আসা শিক্ষক হট কীনা, তার খোঁজ নিয়ে বেড়ায়।    

আমি আমার ‘একা থাকতে যোগ্যতা লাগে বাহে’ লেখায় বলেছি যে, আমার বাসায় আমার ছাত্রছাত্রীরা আসে। না, রোজ আসে না, এতো সময় ওদের নাই, আমারও না। ওরা ছয় মাসে, নয় মাসে একবার আসে, নিজেরাই বাজার করে নিয়ে আসে, আমি রান্নাবান্না করি, ওরা খেয়েদেয়ে আড্ডা দিয়ে চলে যায়। আমার এই সাত বছরের একলা জীবনে যখন আমার আপন জনরা কোন খোঁজ খবর নিতে পারেনি, তখন আমার জ্বরে, আমার দুর্ঘটনায়, আমার যে কোনো ইমারজেন্সিতে ছাত্রছাত্রীরাই পাশে থেকেছে। আর সেসব নিয়ে আমি আমার অন্যান্য ছাত্রছাত্রী, আমার প্রতিবেশী, আমার বাড়ির মালিকের কথাও নেহাত কম শুনিনি। কিন্তু কানে তালা মেরে থেকেছি। কারণ যারা কথা শোনাচ্ছে তারা আমার জ্বরে রাত জেগে আমার সেবা করেনি, কেমন আছি জানতেও চায়নি। তাদের কথায় কান দিলে আমাকে এই শহরে মরে পড়ে থাকতে হবে।

আমার বাসায় আমার ছাত্রছাত্রীদের আসা অনেক কমে গেছে, বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়, কারণ আমি বাড়ির মালিকের চোখ রাঙ্গানি দেখতে দেখতে বিরক্ত। একজন শিক্ষকের বাসায় তার ছাত্রছাত্রীরা আসবে এটাই স্বাভাবিক। ভাগ্যবান সেই শিক্ষক যার বাসায় তার শিক্ষার্থীরা আসতে চাওয়ার কথা বলতে পারে, আসতে পারে! ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেন মালিক আর কর্মচারির মতো হবে! তাদের সম্পর্ক হবে ঈর্ষা করার মতো বন্ধুত্বের।  

শিক্ষিকা বিবাহিতা হলে শিক্ষার্থীর তাঁর বাসায় আসাটা বৈধ, আর অবিবাহিতা হলে অবৈধ, কোথায় লেখা আছে? অপকর্ম করার জন্য কি অবিবাহিতা হওয়া জরুরি? একজন অবিবাহিতা নারীর প্রেম করাটা, প্রেমে পড়াটা, একজন বন্ধু বা মনের মানুষ থাকাটা কি খুব অন্যায়? – যেখানে সমাজে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে পরকীয়া!

আমি মানুষ তাই প্রেম বাসনা, কাম বাসনা, একাকিত্বের কষ্ট সবই আছে, কিন্তু তার মানে কী এই যে আমাকে ছাত্রদের সাথে প্রেম করতে হবে, তাদের সাথে শুয়ে পড়তে হবে! দেশে কী প্রেম করার, সেক্স করার লোকের আকাল পড়েছে যে ছাত্রের সাথে প্রেম করতে হবে! ছাত্র-শিক্ষক প্রেমটা বহু পুরনো বিষয় , বিয়েও হচ্ছে অহরহ – আমার কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা মনে হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় সব শিক্ষক বা শিক্ষিকাই শিক্ষার্থীর সাথে প্রেম করে বেড়ায়, শুয়ে বেড়ায়, বিয়ে করে বেড়ায়। আমি তো ‘মা’ ডাকটা শুনতেই বেশি ভালবাসি আমার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে (সবাই মা ভাবে না সেটা ভিন্ন বিষয় অবশ্য) ।

আমাকে একজন বলেছেন, রাত ১১টায় তোমার কেন বাসায় ফিরতে হবে! আমার কি দাওয়াত থাকবে না, ডাক্তারের কাছে রাত ৮টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকবে না! সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হবে না! নাকি রাত করে বাড়ি ফেরার সব অধিকার ছেলেরা নিয়ে বসে আছে! আমি একা থাকি বলে এতোই কি জলে পড়ে গেছি যে সামাজিক জীবনও বাদ দিয়ে দিতে হবে!

আমি বেড়াতে ভালবাসি। বেড়ানো শেষে যখন ঢাকায় ফিরি তখন ভোর ৫টা – আমি কি তখন বাসায় না ফিরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো! আমাকে বাড়ির সদর দরজা খুলে দেয়া বাড়ির মালিকের দায়িত্ব, কারণ আমি টাকা দিয়ে তার বাসায় ভাড়া থাকি।

অনেক ধর্মের ধ্বজাধারী আমাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বলেছেন, বিয়ে করাটা ফরজ! তারা জীবনে নামাজ নামক ফরজ আদায় করে বলে আমার মনে হয় না। নিজে এক সাথে পাঁচটা প্রেম করে, আজ তার সাথে, কাল তার সাথে শুয়ে বেড়ায় এমন পুরুষেরা আমায় বিয়ের নসিহত দেয়। যারা বোঝেননি আবার বলি আমি বিয়ে বিদ্বেষী নই, বিয়ে করবো না এমন পণ করেও বসে নেই। শুধু একা থাকাটা জীবনের একটা পর্যায়, যেখানে আমি সুস্থভাবে বাঁচতে চাই।

নানান মানুষের নানান কথা শুনে, অনেক সাধ আহ্লাদ ত্যাগ করে, একাকিত্বকে সঙ্গী করে নিজের মধ্যে গুছিয়ে থাকতে, অনেক শারীরিক মানসিক বেদনা সহ্য করে, অনেক হাতছানি উপেক্ষা করে, ভীষণ জ্বরে নিজের রান্না নিজে করে খেয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে হাসিমুখে ক্লাস নিয়ে একা থাকতে সত্যিই যোগ্যতা লাগে বাহে।   

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)  

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.