মুমিতুল মিম্মা:
সম্প্রতি দেশের এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ব্যাচকে আমন্ত্রণ জানাবার সময় আয়োজন করেছিল ভিন্ন ধর্মী অনুষ্ঠান – ‘অভিভাবক দিবস’। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেয়া শিক্ষার্থীদের সাথে মা-বাবার উপস্থিতি আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। নিঃসন্দেহে অসাধারণ এই উদ্যোগকে সাধুবাদ।
আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারে এখনও সেই অবস্থা গড়ে ওঠেনি যেখানে সন্তান তার অভিভাবকের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে খুব স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাবা হচ্ছেন টাকা বানানোর যন্ত্র, যেখানে সন্তানের সাথে তার সম্পর্ক কিছুটা দূরের। এই দূরত্ব পূর্ণ করতে গিয়ে মায়ের সাথে আবার ঘনিষ্ঠ অবস্থান সন্তানদের। সাদা চোখের পারিপার্শ্বিক বিচারে এই আয়োজন সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দেবার একটা চেষ্টা ছিল মাত্র। এই দূরত্ব এড়িয়ে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পা দেয়া সন্তানকে জড়িয়ে ধরে পিতার কান্না দৃশ্য যে কারও চোখে জল এনে দেবে।
একটা জায়গায় গিয়ে খটকা লাগলো – আয়োজনের এক পর্যায়ে মা-বাবাকে বসিয়ে সন্তানকে দিয়ে পা ধোয়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যেখানে বাবা- মায়ের সম্পর্ক হবার কথা ছিল নিতান্তই পারিবারিক, বন্ধুত্বপূর্ণ, সেখানে একটা বিশাল মহড়া করে বাবা – মা বসে আছেন, সন্তানের ঘটা করে পা ধোয়ানোর আয়োজন আমার কাছে লোক দেখানো ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। (যদিও এটা একেবারেই আমার ব্যক্তিগত ভাবনা)।
পা ধুইয়ে কর্তৃপক্ষ কী বার্তা দিতে চেয়েছেন জানি না, তবে আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যাপারটা লোক দেখানো থেকে শ্রদ্ধা-পূজার দিকে চলে গেছে। মা-বাবা এবং সন্তান নিঃসন্দেহে পারস্পরিক আশীর্বাদ। একজন মা-বাবা এ ধরনের প্রদর্শনমূলক শ্রদ্ধার অনেক উপরে অবস্থান করেন (ব্যতিক্রম ছাড়া)। পা ধুইয়ে এর আনুষ্ঠানিকতা যাপনের বেলায় আমার মাথায় ঘোরে একটা অদ্ভুত বার্তা। ফেসবুক, টুইটার চেক-ইন এর জগতে আমরা পারস্পারিক সম্পর্ক ছেড়ে এক অদ্ভুত ভ্রমের জগতে বাস করি যেটার সবটাই আবগে ঢলঢল লোক দেখানো।
ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পা ধোয়ানোর সম্পূর্ণ বিপক্ষে অবস্থান করি। একজন সন্তান তার মা-বাবাকে সময় দিক পরিপূর্ণভাবে। তাদের সাথে যে কোনো বিষয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক করুক। সকাল-বিকেল হেঁটে বেড়াক নির্মল সোনালি আলোয়। অসুস্থ অবস্থায় সেবা করুক। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় কাঁধে কাঁধ রেখে চলুক সন্তান। বাবা-মা একান্ত স্পর্শ পাক আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে, একাকিত্বের ক্ষণে!
এক অদ্ভুত সকালে মাকে বলেছিলাম, “তোমাকে ড্রাইভিং শেখাবো। তারপরে তুমি চালাবে, আমি পাশে বসে থেকে সেটা দেখবো”। মা চকচকে চোখে জিজ্ঞেস করলো, “আমি পারবো?” আমি বললাম, “আমার মতো এক অদ্ভুত জন্তুকে মানুষ করার এই দুঃসাধ্য সাধন করে ফেললে, আর এতো এক মামুলি গাড়ি চালানো!”
আমাদের বর্তমানে চারপাশের অসুস্থ পরিবেশে যেখানে বৃদ্ধাশ্রমের ছড়াছড়ি, সেখানে পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দূরত্ব ঘুচাবার সু্যোগ দেবার চেষ্টা, অবশ্যই ধন্যবাদের দাবিদার। তবে বাহুল্যবর্জিত আনুষ্ঠানিকতাকে সাধুবাদ সবসময়।
চারপাশের ভয়াবহ অশান্ত পরিবেশে সুবোধ সরকারের কবিতাটাই বাজছে মনে- “দেয়ালে পিঠ দিয়ে নগ্ন পলাশপুর কাঁদছে” কেননা “অনেক গ্রন্থ এখনও পড়া হয় নাই” ( সুবোধের এই কবিতাটা মনে ধরেছিল খুব)। তবে এখনও পর্যন্ত সেরা নির্মাণ পেয়েছি সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে।
শুনে দেখার আমন্ত্রণ রইল –