‘নারীত্ব’ ও ‘মাতৃত্ব’ যখন বিতর্কের বিষয়

নাসরীন রহমান:

আজকের নারীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তাঁদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের সমস্যা ; জৈবিক কারণে নারী ও পুরুষের পরিচয় আলাদা; ‘নারীত্ব’ নারীর জন্মগত পরিচয়। স্বাভাবিকভাবে এই পরিচয় নারীকে বহন করতে হয়; ‘নারীত্ব’ নারীর শারীরিক ও মানসিক গুণ, যা তাঁকে পুরুষ থেকে আলাদা পার্থক্য গড়ে দেয়। একজন নারী চাইলেই তাঁর ‘নারীত্ব’কে অস্বীকার করতে পারেন না, তবে নিজেকেই অস্বীকার করা হয়। নারী সন্তান ধারণ করেন, পুরুষ তা পারেন না, চাইলেও পারবেন না। কিন্তু এই ব্যাপারটি নিয়ে যদি পুরুষ কোনও সুবিধা ভোগ করেন তবে সেই দায় কি নারীত্বের?

না; নারীত্বের নয়; পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নারী কেন তার ‘নারীত্ব’কে নিজেই অবহেলা করবেন?

পুরুষ তার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নারীকে কখনো বুঝতে দেননি ‘নারীত্ব’ হীনমন্যতার কিছু নয়, বরং অহংকারের। পুরুষ যদি ‘পৌরুষ’ নিয়ে অহং দেখাতে পারে তবে নারী তাঁর ‘নারীত্ব’ নিয়ে কেন নয়? সমাজে ‘বিশেষ অক্ষম ‘ পুরুষদেরও দেখা যায় কী দাপট! তবে নারীর যদি শারীরিক অসুবিধার কারণে সন্তান ধারনে অক্ষম হন, তার জন্য হীনমন্যতার কী আছে?’ মাতৃত্ব ‘ বলতে শুধু কি সন্তান নিজেকেই জন্ম দিতে হবে নারীকে, তাই বুঝায়?

কতো মাই তো সন্তান দত্তক নেন, ‘মাতৃত্ব’ বোধের তাড়নায়ই তো নেন; অভিনেত্রী জোলি, তিনি তাঁর কিছু অঙ্গ সার্জারি করেছেন ক্যানসার থেকে বাঁচতে; তাতে কি আমরা বলবো জোলি ‘নারীত্ব’ হারিয়েছেন? ‘মাতৃত্ব বোধ’ হারিয়েছেন?  নারীত্ব বা মাতৃত্ব কি একক কোনও শর্তের উপর নির্ভর করে ? পুরুষ সুবিধা ভোগ করছেন সর্ব যুগে, সকল সময়; এই অবমাননা থেকে নারীকে মুক্তির পথ তাদের নিজেদেরই খুঁজতে হবে তবে আত্মপরিচয় বিসর্জন দিয়ে নয়।

আজ মাতৃত্ব কেন বোঝা মনে করছেন অনেকে? ঢাকার রামপুরা বনশ্রীতে আমরা দেখি, মা’ই সন্তানের ঘাতক!
‘মাতৃত্বের’ এই বোধের দুর্দশা কেন আজ? কারণ মানসিক বা সামাজিক সমস্যা ভারে পিষ্ট নারী জীবন; এ থেকে পরিত্রাণ পেতে নারী আজ সন্তান হন্তারক পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা এলার্মিংই বটে!

নারীর অধিকার, স্বাধীনতা নিয়ে সর্বপ্রথম লিখে আলোচিত হন, মেরি। তিনি চেয়েছিলেন বিবাহ প্রথা উঠে যাক। তার পরিবর্তে নারী পুরুষের সমঅধিকারের ভিত্তিতে ‘বন্ধুত্বের’ সম্পর্ক হোক। কিন্তু মেরির এই মতবাদ টিকেনি, বর্তমানে তো নয়ই, মেরির সময়কালের নারীবাদীরা, সমাজ সংস্কারকেরাও তাঁর মতবাদের সমালোচনা করেছিলেন।

পৃথিবীর অনেক দেশেই নারীর সামগ্রিক অবস্থা পাল্টেছে, কিন্তু তারপরও নারীর কাঙ্ক্ষিত অবস্থার উন্নয়ন হয়নি; নারীর এই দুর্দশা থেকে তাঁর নিজেকেই প্রতিকার পেতে হবে এবং আত্মপরিচয়ের মাধ্যমেই; ‘ মাতৃত্ব’ নারীর জন্য হীনমন্যতার কিছু না, নারীর প্রগতির পথেও অন্তরায় নয়; বরং নারীর সামগ্রিক পরিচয়ের এক অংশ।

‘নারীত্বের পূর্ণতা’র খোঁজে নারী ‘মাতৃত্ব’ চান, এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, একক ভাবে ‘মাতৃত্বেই’ নারী জীবনের পূর্ণতা খোঁজা হচ্ছে ; ব্যাপারটি এমন মনে হচ্ছে, গত পোস্টে লিখেছিলাম, ‘ পহেলা বৈশাখের শাড়ি কেনা শুধু আনন্দ নয়, মৌলবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই ‘, অনেকেই বুঝতে পারেননি কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য; রীতিমতো এ টু জেড সবসময় বুঝিয়ে দেওয়া কি সম্ভব!

শেয়ার করুন: