একাত্তরের নারী

ফিরোজ আহমেদ:

নারীদের জন্য ১৯৭১ সাল কেমন ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও তত্ত্বের অভাব নেই। একটু পেছন ফেরা যাক…

১৯৫২ থেকে শুরু হয় মেয়েদের পদযাত্রা। তখন মিছিলে নারী থাকতো সর্বাগ্রে। মেয়েদের আলাদা মিছিল হতো এবং নারীদের সেই মিছিলও কাঁপন ধরাতো লাঠিধারী-বুলেটবর্ষী পুলিশবাহিনীর বুকে। মেয়েদের মিছিলে সারি-সারি মুখ, তাদের মাথায় রৌদ্রের কারণে ঘোমটা দেখা গেলেও আজকের দিনের মতো হিজাব দেখা যায়নি।

এখনও বিভিন্ন যাদুঘর, আর্কাইভ বা অন্যান্য সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত চিত্রে দেখা যায় ১৯৫২ থেকে শুরু করে গণহত্যা শুরু হওয়ার দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিলে বালিকা-কিশোরী সহ নারীদের অংশগ্রহণ ছেলেদের সংখ্যার সমান না হলেও ছিল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এবং অবগুণ্ঠনমুক্ত ও সংস্কারহীন। এসকল বিক্ষোভ সমাবেশ কিংবা মিছিল প্রায়শই শান্তিপূর্ণ থাকতো না। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া ছিলো নৈমিত্তিক, যেখানে নারীরাও পিছিয়ে থাকতো না। এমনও দেখা গেছে কোমরে আঁচল বেঁধে মিছিলে নামা নারীদের অগ্নিমূর্তি দেখে পিছিয়ে গেছে পেটোয়া আইয়ুব-ইয়াহিয়া বাহিনী। বেষ্টনী ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে মিছিল। বরাবরই মিছিলের সামনে থাকতো মেয়েরা। অনেক সময় পুলিশ সামনে থেকে আক্রমণের সাহস পায়নি, বেষ্টনী পার হয়ে যাওয়ার পর পেছন থেকে আঘাত হেনেছে কাপুরুষের মতো।

যাহোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। নারীদের জন্য ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাত্রি পর্যন্ত ছিলো দুর্জয় সাহসের, দূরন্ত দ্রোহের আর সমাজ ভাঙার কারিগরি চর্চার। পরিবর্তন ঘটে এর পর। গণহত্যার প্রথম লগ্নে স্বাধীনতার ঘোষণার প্রায় সাথে সাথে চলে আসে পতাকা আর মানচিত্র। মাত্র দুই সপ্তাহ পর গ’ঠিত হয় সরকার। এরই সাথে পরিবতর্ন হয় এই মানচিত্রের মাঝে বসবাসকারী সাড়ে সাত কোটি নারী-পুরুষ-শিশুর।

পুরাণ কিংবা ইতিহাস থেকে আমরা জানি ক্ষত্রিয় শব্দটি পুরুষবাচক। নারী ক্ষত্রিয় হয় না। নারীর বীর্য নেই, তাই বীরত্বও নেই। নারী শুধু বীরভার্যা-বীরপ্রসবা মাত্র। সাম্রাজ্য দখলের যুদ্ধে কিংবা রাজত্ব জবরদখলের লড়াইয়ে নারীদের কথা লিখিত ইতিহাসে নেই বললেই চলে। কিন্তু দাসযুগে দাসত্বের শৃখল ভাঙার স্পার্টাকাসের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি মুক্তিসংগ্রামে নারীরা ছিলো অকুতোভয় যোদ্ধা। প্রতিটি মুক্তিসংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অবিচ্ছেদ্য। ব্যাতিক্রম নয় বাঙালি নারীরাও। ১৯৫২ থেকে একাত্তর পর্যন্ত রাজপথে কিংবা একাত্তরের নয়মাস বাঙালি নারীরা ছিলো শক্ত প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের সৈনিক।

নারীদের মুক্তিসেনা হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জায়গাটা বিশাল। সে বর্ণনার জন্য আজ পর্যন্ত, দুই-একটি বাদে, তেমন কোন খাতা-কলম পাইনি।  একাত্তরের দুই কোটি নারী নিয়ে সত্যিকার কোন নিবন্ধ আমার চোখে পড়েনি। এই চোখে না পড়ার বিষয়টি আমার পাঠের সীমাবদ্ধতা হতে পারে। কিন্তু লিখিত ইতিহাস, ছাপার অক্ষরে যা পাওয়া যায় তা কতটুকু ইতিহাসনির্ভর – সে প্রশ্ন অনাদিকালের। যাহোক বিস্তৃত এ প্রেক্ষাপটের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশে আমি দৃষ্টি দিতে চাই, ফোকাস করতে চাই বাঙালির সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামের নয়মাসে নারীদের উপর আঘাতের বিষয়টিকে।

পাকিস্তানের ফৌজি আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির চরিত্রবদল। সমরবিজ্ঞান অনুযায়ী চরিত্র বদলে দেয়ার ক্ষেত্রে সকল সমরবিদ একই কায়দা গ্রহণ করেছেন। এই কায়দার নাম চেহারা বদলে দেয়া। একই সাথে মানুষ ও ভূখণ্ডের। আমেরিকার ভূখণ্ড দখলের সময় অধিবাসী নাভাহো, কোমাঞ্চি, মোহিকানসহ সকল রেড ইন্ডিয়ান পুরুষকে হত্যা করে, তাদের রমনীদের ধর্ষণ করে, ধর্ষিতদের গর্ভে সন্তান দিয়ে দোআঁশলা সন্তান পৃথিবীতে এনে কিট কার্সনের স্কাউট বাহিনী চেহারা বদলেছে আমেরিকার। ঘটনার পুনরাবৃত্তি অস্ট্রেলিয়ায়, নিউজিল্যান্ডে কিংবা তাহিতি অঞ্চলের পলিনেশিয়ান দ্বীপমালাতেও। হিজ ম্যাজেস্টি রয়াল নেভির ক্যাপ্টেন কুকসহ নৌবহরের নাবিকগণ এসকল ভূমিজ সন্তানদের সরল যৌনতার সুযোগ নিয়ে চেহারা বদলে দিয়েছে প্রজন্মের। তাদের পুরুষদের দাস বানিয়েছে, অবাধ্য হলে হত্যা করেছে। পাকি ফৌজিরা চেহারা বদলের এই খেলায় নামে গণহত্যাযজ্ঞের প্রথম প্রহর থেকে।

গণিমতের মাল হিসেবে উঠিয়ে যায় শত শত নারীকে। (প্রথা অনুযায়ী পুরুষদেরও দাস বানাতে চেয়েছিল মাসিক ১০০ টাকা বেতনে রাজাকার-আলবদর-আলশামসের চাকুরি দিয়ে। সেটি আপাতত এ আলোচনায় রাখছি না)। নির্বিচারে নরহত্যা ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি তারা চেয়েছিল সকল নারীকে পাকি ফৌজের অঙ্কশায়িনী করতে। যাতে পাওয়া যায় পোড়ামাটি আর ধর্ষিত নারীর গর্ভে জন্মানো উন্নত নাসিকাসম্পন্ন উজ্জ্বল গাত্রবর্ণের সন্তান। যে সন্তান নিয়ে মাতৃত্বের গর্ব থাকবেনা, থাকবে শুধু কলঙ্ক। বাঙালি আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

১৯৭১ তাই নারীদের জন্য প্রথমটুকু (রুখে দাঁড়ানোর পূর্বে) ছিল পলায়নপর্ব। কন্যাশিশু থেকে শুরু করে সকল নারীকে বাসগৃহ ফেলে পালাতে হয়েছে ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা আর সংবাদ প্রবাহ আজকের মত ছিল না বলে শেষ মুহূর্তে পালাতে যেয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে কতজনকে তা লেখাজোখা নেই ইতিহাসে। নিশ্চিন্তে বসবাসরত পরিবারগুলো হঠাৎ শুনতো গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে। সবকিছু ফেলে পালাতে শুরু করতো নারী-পুরুষ-শিশু সবাই। এভাবে শহর থেকে গ্রামে, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে লোকালয় ভেঙে মানুষ পালাতে থাকে। পথিমধ্যে হাত ছুটে যায় শিশুটির। বাবা কিংবা মা পলায়নকালে খেয়াল করে নাই শিশুটি কোথায়। নিরাপদে কোথাও ঠাঁই নেয়ার পর খেয়াল হয়েছে। কিশোরীরা এ ঘটনার শিকার হয়েছে সর্বাধিক। কোলের বাচ্চাকে যথাসাধ্য কোলে নিয়েই দৌড় দিয়েছে মা-বাবা। কিন্তু ৯-১৪ বছরের কিশোর-কিশোরীরা বাবা-মাকে অনুসরণ করে দৌড়েছে। পথিমধ্যে অনেকেই হারিয়ে গেছে। মৃত্যু হয়েছে, নয়তো গ্রহণ করতে হয়েছে ভয়াবহ এক বাস্তবতাকে।

আগস্টের রাজাকার অর্ডিন্যান্স পাশ হওয়ার পর দেশী কিছু দাস পাকি ফৌজিদের কাছে বিক্রয় হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এতদিনকার শহর ছেড়ে গ্রামে, এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে, ধানক্ষেত, বনে-বাঁদাড়ে লুকিয়ে থাকার বাঙালি হাইড-আউটগুলো সবই এদের জানা থাকায় হত্যাযজ্ঞ আর নারী অপহরণ মাত্রা ছাড়ালে মানুষ বাধ্য হলো দেশ ত্যাগ করতে। প্রায় এক কোটি শরণার্থীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ছিল নারী ও শিশু। দেশত্যাগের এই যাত্রাপথ ছিল ভয়াবহ। রাস্তায় মিলিটারি আক্রমণ, আকাশপথে বোমাবর্ষণ, বিহারি কর্তৃক লুণ্ঠন-হত্যা, চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলা, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় পথের পাশের পুকুর-ডোবার দূষিত পানি ডায়রিয়া-কলেরায় মারা গেছে প্রায় ১৪ লক্ষাধিক নর-নারী-শিশু।

যশোর রোডের দুপাশে ১৯৭৪-৭৫ সার পর্যন্ত মানুষ চাষ দিত না। লাঙ্গল দিলেই উঠে আসত মানুষের হাড়। শরণার্থী শিবিরে পৌঁছেও ধকলের পর মারা গেছে বহু নারী ও শিশু। অনেক মা শুধু কোলের সন্তানটার জন্য পথের কষ্ট ঠেলে বেঁচে ছিল। শরাণার্থী শিবিরে পৌঁছে স্বেচ্ছাসেবকের হাতে কোলের সন্তানকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটেছে।  

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে নারী ও শিশুর উপর আঘাত এসেছে সবচেয়ে বেশি, ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ।

একজনের কথা বলে শেষ করি। ১৯৯২ সাল। সচিবালয় এক্সচেঞ্জে চাকুরি করতেন হোসনে আরা নামে এক টেলিফোন অপারেটর। সিরাজগঞ্জ জেলায় বাড়ি। অত্যন্ত হাসিখুশি, সুশ্রী এই নারী মাতিয়ে রাখেতেন তার কর্মক্ষেত্র। বয়স তার তখন ৩৭-৩৮ হবে। কোনদিন সর্দি-কাশি হলে সচিবালয় ক্লিনিকে যেতেন চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার বয়স (চিকিৎসার জন্য বয়স জানা অত্যাবশ্যক) জানতে চাইলে প্রকৃত বয়স না বলে রসিকতা করে হোসনে আরা বলতেন – “আমার বয়স ২২ কি ৬০”। চিকিৎসকরা চিকিৎসাপত্রে অনুমানে বয়স লিখতেন- “২৮”। রসবোধসম্পন্ন এই নারীর মুখে কেউ কোনদিন অন্ধকার দেখেনি। অথচ ১৯৭১ সালে হোসনে আরা হারিয়েছেন অনেক কিছু…

সেদিন স্বচ্ছ ভোরের আকাশ। সিরাজগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে হোসনে আরার মাসহ সকল ভাই-বোন উঠানে বসা। হঠাৎ শোর উঠল মিলিটারি এসেছে। মা মাছ কুটছিল, আঁশবটি ফেলে সকলে মিলে দৌড় শুরু। কখন বটিতে পা লেগে হোসনে আরার পায়ের গোড়ারির উপরের ভাঁজে ভয়াবহ যখম হয়েছে সে জানেই না। ডাক্তার-বদ্যি নাই, কী করে পায়ের সেই ক্ষত শুকিয়ে ছিল তা হোসনে আরার পরবর্তীতে আর মনে ছিল না। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাই তার কাছে এক অনন্ত বিষ্ময়। হোসনে আরার গ্রামে যখন দ্বিতীয়বার আক্রমণ হয়, তখন তারা বাধ্য হয় পথে বেড়িয়ে পড়তে। তারা ছিল ছয় বোন। সবচেয়ে ছোট বোনটার বয়স ছিল দশবছর। পরিবারের সবার সাথে হোসনে আরা খোঁড়াতে খোঁড়াতে টানা একদিন দৌড়িয়ে এবং দুইদিন হেঁটে পৌঁছায় দূরের এক গ্রামে-যেখানে আপাতত মিলিটারি আসে নাই। তিনদিনের এই ধকলের পর প্রথমবার বিশামের জন্য বসে দেখে তাদের সঙ্গে সবচেয়ে ছোট মেয়েটা নেই। পথের মাঝে কোথায় কখন হারিয়ে গেছে কেউ জানে না। মেয়েটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সহকর্মীদের মাঝে এ ঘটনা বর্ণনা করতে করতে হোসনে আরার শুভ্র গালে কখন নেমে এসেছে পানির রেখা কেউ খেয়াল করেনি।

হোসনে আরার গল্পটা একাত্তরের ক্যানভাসের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ। ক্যাম্পে অপহরণ করে নিয়ে দিনের পর দিন নারীকে গণধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে উলঙ্গ করে বেঁধে রাখা (শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করবে এই জন্য), ব্যবহার অনুপযোগী বোধ হলে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে ভাসিয়ে দেয়া – বর্ণনাতীত পৈশাচিকতা…লিখতে গেলে আবেগ ধরে রাখা কঠিন হয়..

একাত্তর পাড়ি দিয়ে বেঁচে থাকা বেশিরভাগ নারীর ঐ নয় মাস, মূলত, হোসনে আরা নয়তো ক্যাম্পের পিশাচসঙ্গে কাটানো কোন না কোন নারীর গল্প…

শেয়ার করুন: