জেসমিনা হক:
-হাই
-হাই
– কেমন আছিস-
– ভালো
– চিনতে পারছিস
– দাঁড়া তোর প্রোফাইলটা দেখে নেই
– বুঝছি চিনতে পারিস নাই, ভাল থাক,
– আরে রাগ করিস কেন? কত বছর পর……

চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকে সেঁজুতি, মানুষের জীবনটা এমন কেন! যখন বলার সময় ছিল তখন সাহস ছিল না; আর যখন সাহস জন্মালো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভার্সিটি জীবনে কেউ কোনদিন কারো সাথে কথা বলে নাই। তারপর দুম করে সমস্ত আশা লণ্ডভণ্ড করে তার চেয়ে ডাবল বয়সী মানুষটার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। সবকিছু ভুলে বরের আর বরের পরিবারের সদস্যদের মন রক্ষার্থে ব্যস্ত সেঁজুতি নিজেকেই হারিয়ে ফেললো।
সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার দু’টি পরিবার। বাবা মারা যাওয়ার পর সেঁজুতির মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নতুন স্বামীর সাথে সংসার করার জন্য মরিয়া সেঁজুতির মা সেঁজুতিকেই সবচেয়ে বড় বাধা ভাবতে লাগলেন। তারপর হুট করে মফস্বলের টিপিক্যাল মানসিকতা সম্পন্ন একটা পরিবারে প্রায় জোর করে সেঁজুতির অমতে বিয়ে হয়ে গেল। কীভাবে যেন পনেরটা বছর কেটে গেল। এই পনেরটা বছরে সেঁজুতি খালি নিজের দোষ কাটানোর আর স্বামী ও তার পরিবারের ছোট-বড় সবার প্রতি দায়িত্ব পালন এবং তাদের সন্তুষ্ট করতেই তটস্থ থাকতো।
“তোর তো কোথাও যাবার জায়গা নাই, তাই আমি তোর সাথে যেমন ব্যবহারই করি তুই এখানেই থাকবি” প্রায়ই এই কথা তাকে শুনতে হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ের পর মাস্টার্স পাস করে সেঁজুতি, তারপর স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা চাকরি যোগাড় করে নেয়। কিন্তু মাস শেষে বেতনের প্রায় সব টাকাই স্বামীকে দিতে বাধ্য সে। এদিকে সেঁজুতির স্বামী প্রবরটি সমাজে এবং সেঁজুতির পরিবারেও অনেক ভালো মানুষ কিন্তু। তার মতো মানুষ হয় না। যে কোনো বিপদে সে শ্রম ও অর্থ দিয়ে সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই কিছু বলতে গেলেই সেঁজুতি শুনে তার মতো মানুষ হয় না, মানিয়ে নিতে চেষ্টা করো; দোষ তোমার মধ্যেই ।
সেঁজুতি যে সমাজের বাসিন্দা সেখানে কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে কলঙ্ক তার হবে। ধর্ষক অচ্ছুত নয় এখানে, ধর্ষিতা অচ্ছুত, নষ্ট বলে বিবেচিত হয়। সেখানে কাগজে বৈধতা পাওয়া স্বামী নামক পশুটি যখন ধর্ষণ করে, সেসব কথা কেউ শোনে না। প্রতি মুহূর্তে রাস্তা-ঘাটে, সন্তানের সামনে দুর্ব্যবহার করা যেন স্বামীর অধিকার। এসব সামলে উঠতে উঠতে কখন যে সেঁজুতি শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায় শ্বাস–প্রশ্বাস চালিয়ে যাচ্ছিলো, সে তা বলতে পারবে না।
সেই যে মানুষটা যার সাথে তার কোনদিন দু’টো কথাও হয়নি, অথচ সেই ইউনি লাইফেও এই মানুষটাই ছিল সেঁজুতির বেঁচে থাকার প্রেরণা। কোনো আত্মীয় না, কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু এত্তো মিল! মানুষটা অনেকটা সেঁজুতির হারিয়ে যাওয়া বাবার মতো দেখতে ছিল। বাসায় নতুন স্বামীর সাথে মায়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো দেখে যখন সেঁজুতির মরে যেতে ইচ্ছে হতো, ইউনিতে এসে ঐ মানুষটিকে দেখে সেঁজুতির নতুন করে আশা জাগতো লেখাপড়া করার, বেঁচে থাকার।
আজ এতো বছর পর কেমন যেন নাটকীয়তার মতো আবার তার সাথে দেখা হলো। বয়স, সময় সবকিছু মিলিয়ে সেঁজুতি তার সাথে কথা বললো। কথায় কথায় সেঁজুতির না বলা কষ্টের কথাগুলাও শেয়ার করলো। আসলে বাবার মতো দেখতে মানুষটিকে সেঁজুতি মনের অজান্তেই তার বাবার পাশে ঠাঁই দিয়েছিল। আর সেঁজুতি যখন মানসিকভাবে অনেক ভেঙ্গে পড়ে, লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, তখনই কাকতালীয়ভাবে এই মানুষটা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আর সেঁজুতি নামহীন, ব্যাখ্যাহীন একটা সম্পর্কের শক্তি নিয়ে আবার নিজেকে সামলে ওঠে। আবার চলতে শুরু করে তার বন্ধুর জীবন পথ।
বর্তমানে সেঁজুতির সংসারে অশান্তি চরমে। মূল কারণ সেজুতির প্রমোশন ও বেতন বৃদ্ধি। সামাজিক পরিচয়ে সে তার স্বামীর চেয়ে বেশি যোগ্য। তাই প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে শুনতে হয়– —তার স্বামী পারমিশন দিয়েছে দেখেই সে চাকরিটা করতে পারছে; নইলে এই যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারতো না। কোন কিছুতে দ্বিমত পোষণ করলেই শুনতে হয়, ‘অফিসের বেটারা এখন তোর কাছে মজা লাগে, তাই না? তাই তো তুই এখন নিজের মত দিতে চাস’।
সেঁজুতি সেদিন মরমে মরে গেল যেদিন তার স্বামী তাকে তার বারো বছরের ছেলের সামনে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিল। আর সেঁজুতিকে মেরে রক্তাক্ত করলো। সেঁজুতি আত্মহত্যা করার মনস্থির করলো। ঠিক তখনই সেই মানুষ, যাকে সেঁজুতি এখন দেবদূত ভাবে, সে ফোন করলো।
সন্তান, মা, বোন, সমাজ, সবাই বলে কী করবা, এটা তোমার ভাগ্য। সংসার ভেঙো না, স্বামীকে মেনে নাও। শুধু সেই দেবদূত তাকে বললো, তুই ঘুরে দাঁড়া, দেখ তোর অনেক শক্তি। পরিবারের যে পরিবেশ তা তোর সন্তানের জন্যে মঙ্গলজনক নয়। তুই ঘুরে দাঁড়া। সামান্য, নগণ্য, সারাটা জীবন সব অন্যায় মেনে নেয়া সেঁজুতি তখন ঘুরে দাঁড়ালো। যে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সব মেনে নিয়েছিল, সেও তখন বাপের জন্য আহ্লাদে পাগল।
সেঁজুতি বললো, তুমি তোমার বাবার সাথে থাকো তাহলে। কিন্তু সন্তানের কথা তোমাকে ছাড়া বাবার সাথে থাকতে পারবো না সেটা তুমি জানো। নিজের বাবাকে হারিয়ে জীবনের মানেটাই পাল্টে যাওয়া, সেজুতি ভাঙতে গিয়েও আর ভাঙতে পারে না সংসারটা। কিন্তু হ্যাঁ, সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার প্রতি সমস্ত অন্যায়ের বিপক্ষে।
সেঁজুতি এখন শিখেছে, আসলে শুধু মানিয়ে নেয়া, মেনে নেয়া বা বদলে গিয়ে নয়; কখনো কখনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতেও সম্পর্ককে শাসন করতে হয়।
নারীর অজস্র অশ্রুর কারণ যদি কোনো পুরুষ হয়, আবার তার শক্তির সহযোগীও কোনো পুরুষই হতে পারে। সেই যে সেঁজুতির বাবার মতো দেখতে মানুষটি তার সাথে কিন্তু সেঁজুতির আর যোগাযোগ নেই। কিন্তু প্রতিদিন সে তাকে স্মরণ করে মানুষ হিসেবে নয়, দেবদূত হিসেবে। কারণ সেঁজুতি আবার বাঁচতে শুরু করেছে তার দেয়া মানসিক শক্তির জোরেই।