নারী দিবস মানেই লিঙ্গবৈষম্য জিইয়ে রাখা!!!

শিল্পী নাজনীন:

মনে আছে বহুবছর আগে কোনো এক কথার সূত্র ধরে গ্রামের লেখাপড়া না জানা এক নারী আমাকে বলেছিল, ‘পুরুষের জিদ থাকলে সে হয় বাদশা, মেয়ের জিদ থাকলে সে হয় বেশ্যা’!

কথাটায় এতোটাই বিস্মিত, হতভম্ব হয়েছিলাম যে আর কোনো কথা মুখে যোগায়নি সে মুহূর্তে। মনে মনে শুধু বলেছিলাম, এদের জ্ঞান দাও প্রভু! এদের ক্ষমা করো! কথাটা সে আমাকেই বলেছিল, সন্দেহ নেই। আমার জেদ আমাকে বেশ্যা করেছে কীনা, কিংবা কতজন পুরুষ তাদের জেদের কারণে বাদশা হয়ে উঠেছে সে বিতর্ক তোলা থাক আজ।

শিল্পী নাজনীন

বিশ্ব নারী দিবস নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারও যে মস্করা হয়েছে, সে নিয়ে বলা যাক দু চার কথা।

পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর যুক্তি প্রদর্শন চলছে, চলছে নারী দিবসের নামে নারীদের নিয়ে নানা ঠাট্টা মস্করা। অবাক হচ্ছি না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী চিরদিনই অপমান, অবহেলা, বঞ্চনা আর নির্যাতনের শিকার। ঠাট্টা সেখানে নস্যি। আর আমাদের নারীদের চামড়া এতটাই শক্ত যে তা এমনকি গন্ডারকেও লজ্জা দেয়। যাদের অতোটা নয় তাদেরকে আমার মতোই বেশ্যা অপবাদ সহ্য করতে হয়।

যে নারী আমাকে প্রকারান্তরে বেশ্যা বলেছিল, সত্যিই কি সেই বেশ্যা বলেছিল আমায়? না, সমাজ তাকে দিয়ে বলিয়েছে। সমাজ তাকে যা শিখিয়েছে, তোতাপাখির মতো তাই সে আওড়েছে, আওড়াবে আজীবন। এই চালাকি, ধূর্তামি পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের। আমরা জন্মাই অন্ধ হয়ে, শিক্ষা আমাদের মনের চোখ খুলে দেয়, ধীরে ধীরে আমরা চক্ষুষ্মান হই, আলোকিত হই। সমাজ সে শিক্ষা থেকে আমাদের বঞ্চিত করে নারী পুরুষ নির্বিশেষে।

সমাজের চোখ দিয়ে আমরা দেখি, সমাজের নাক দিয়ে আমরা নিঃশ্বাস নিই, সমাজের বেঁধে দেয়া গণ্ডির মধ্যে আমরা নিজেদের অজান্তেই বাঁধা গরুটি হয়ে কাটিয়ে দিই একটি জীবন। অনেকেই, এমনকি নারীদেরকেও বলতে শুনি, নারীদের শত্রু নারীরাই! শুনে করুণা হয়। অন্যের চোখে দেখে, অন্যের শেখানো বুলি আওড়ে জীবন যায় যাদের, যারা সত্যিকারের শিক্ষার আলো থেকেই বঞ্চিত, বিন্দুমাত্র মানসিক বিকাশ যাদের হয়নি, তাদের কাছে কতটুকু যথার্থ আচরণ আশা করা যায়?

যারা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নামের সাথে ‘স্বামী’ নামক শব্দটি যোগ করে, ‘স্বামীর’ নামের ভগ্নাংশ নিজের নামের সাথে যোগ করতে যাদের বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা হয় না, তারা তো পুরুষতন্ত্রেরই তল্পিবাহক মাত্র! মনের মধ্যে যারা লালন করে চলেছেন গহীন অন্ধকার!

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বহু মেয়েকে দেখেছি যাদের স্বপ্ন একটা ভালো বিয়ে! এই স্বপ্ন তাদের মধ্যে প্রোথিত করেছে কে? সমাজ! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ! সমাজের কাছ থেকে তাই সুশিক্ষা আদায় করতে হবে।

সমানাধিকার কার কাছে চাইছি? আমার অধিকার আমার! আমি তা আদায় করে নিবো, কাঙালের মতো অন্যের কাছে হাত বাড়িয়ে চাইতে যাবো কেন? কেন তাকে আমার প্রভু ভাবার সুযোগটুকু দিবো? আমাকেই সে অধিকারের যোগ্য হতে হবে, হতে হবে শিক্ষিত, আত্মনির্ভর। অবশ্যই প্রথাগত শিক্ষার কথা বলছি না। অশিক্ষিত, তথাকথিত মূর্খ নারী-পুরুষ দেখেছি, যারা নিজেদের মনের অন্ধত্ব ঘোচাতে পেরেছেন, নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, মনের মধ্যে জ্বেলে নিয়েছেন সত্যিকার আলোর ফুলঝুরি, সংখ্যায় অবশ্যই নগণ্য তারা।

অন্যদিকে বহু শিক্ষিত নারী-পুরুষ দেখেছি, সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রিটি ঝোলায় পুরেও যারা নিজেদের অন্ধত্ব দূর করতে পারেননি, হোঁচট খেয়ে মরছেন তথাকথিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত সমাজের অযৌক্তিক প্রথা আর সংস্কারের গোলকধাঁধায়।

পরিচিত এক বন্ধু, তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, উচ্চশিক্ষিত, প্রগতির কথা বলেন, শিল্পচর্চা করেন, কিন্তু সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে স্ত্রীকে দিয়ে দাসীবৃত্তিও করিয়ে নেন। এই নেওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক, কতটুকু অযৌক্তিক সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিন্তু বন্ধুটির মানসিকতা এমন, যেহেতু তিনি ‘স্বামী’, উপার্জন করছেন, সে কারণে তার স্ত্রী তার জন্য দাসীবৃত্তি করবে এটা খুব স্বাভাবিক।

কথা হলো এ সমাজে উপার্জনক্ষম নারীও এখন দুর্লভ নয়, তারা যদি আশা করে তাদের জীবন সঙ্গীও তাদের জন্য একইভাবে ‘দাসবৃত্তি’ করুক, সে আশা কতটুকু অন্যায় হবে, যদি পুরুষেরটা ন্যায় হয়ে থাকে?

নারীমুক্তির কথা বললেই প্রথমে চলে আসে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। প্রচলিত ধারণা এমন যে অর্থনৈতিক মুক্তি হলেই নারীর উপর অন্যায়, অত্যাচার, সহিংসতা বন্ধ হবে। কিন্তু সত্যিই কি হবে? হয়? আমরা কি ভুলে গেছি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষক রুমানা ম্যাডামের কথা? তিনিও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বি ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ছিলেন, কিন্তু সেই তাকেও কি অপগণ্ড ‘স্বামী’ নামক জীবটির হাতে নির্যাতিত হয়ে মেনে নিতে হয়নি অন্ধত্বের মতো নারকীয় যন্ত্রণা?

তাই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন শিক্ষা, সুশিক্ষা। নারী-পুরুষ সবারই তা প্রয়োজন। এই শিক্ষাটা শুরু হতে হবে ব্যক্তি থেকে, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, রাষ্ট্র থেকে। এবং নারীকে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, তার অধিকার কারও কাছে গচ্ছিত নেই। তার অধিকার তার। এই অধিকার তাকে আদায় করে নিতে হবে এবং সে জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। নিজের মনের অন্ধত্ব তাড়াতে হবে। মানসিক পঙ্গুত্ব যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ অধিকার নামক সোনার হরিণটা শুধুমাত্র নারী দিবসে পারসোনায় গিয়ে রং মেখে র‌্যালিতে শ্লোগান আর সংবাদপত্রের পাতায়, টিভির পর্দায়ই দেখা যাবে।

জনৈক প্রবাসী নারীর মতে, এখন নাকি ‘সমানাধিকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দেশে এবং দেশের বাইরে! তাকে বলি, চোখ থেকে রঙিন চশমা খুলে সাধারণ মানুষের দিকে তাকান, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সাথে মিশুন, উচ্চবিত্তের অন্দরমহলে একবার উঁকি দিয়ে দেখুন, ‘সমানাধিকার’ বুঝতে পারবেন! তাই নারী দিবস নিয়ে যারা বাণিজ্য করেন, তাদের ভড়ং নয়, চাই সুশিক্ষা, চাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, চাই মানসিক পঙ্গুত্বের অবসান এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি।

পুরুষ বা নারী নয়, যেদিন আমরা নিজেদেরকে চিনতে শিখবো মানুষ বলে সেদিনই প্রতিষ্ঠিত হবে ‘সমানাধিকার’। নারী দিবস মানেই লিঙ্গ বৈষম্য জিইয়ে রাখা,  চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া, তুমি মানুষ নও, নারী।

হ্যাঁ, আমি অবশ্যই নারী, তার আগে আমি মানুষ। সমাজ আমার মানুষ পরিচয় মুছে দিতে চেয়েছে বলেই নারী দিবসের সূচনা। ইতিহাসের দোহাই দিয়ে ঘটনা, অনুঘটনা টানলেও মোদ্দা কথা এটাই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.