নারীর মর্যাদা নয়, চাই মানুষের মর্যাদা

জেসমিন আক্তার:

নারী অধিকারের কথা বলা মানে কিছু মানুষের কাছে অযথা বকবক করা ছাড়া আর কিছুই না। কেউ ভাবে এসব পাগলামি।আর কারও মতামত, অন্য নারীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে, কিন্তু আমি তো হচ্ছি না, তাই সমাজকে এসব দেখিয়ে দেওয়ার কোন অর্থ আমি খুঁজে পাই না।

জেসমিন আক্তার

অনেকের ধারণা, নারী তার অধিকারের কথা বলছে, এর অর্থ তারা ধরে নেয় নারীরা খোলামেলা পোশাক পরতে চাচ্ছে, শরীর দেখাতে আর সেক্স করতে চাচ্ছে। তারা বুঝতে প্রস্তুত না, সব নারী দামী গহনা, দামি জামাকাপড়, সিরিয়াল দেখা, আর ধনী স্বামী পাওয়ার মধ্যে সুখ খুঁজে পায় না। সমাজের মানুষ ভাবে নারীরা ওসব পেয়েই সুখী। তারা কী করে বুঝবে, পুরুষ যেমন শৈশবে খেলতে চায়, নারীরাও তাই চায়। কিন্তু তাদেরকে খেলতে দেখতে চায় না এ সমাজ।

পুরুষ যখন অনেক গরমের মধ্যে শার্ট ফেলে টি-শার্ট পরে যাতে তাদের একটু ঠাণ্ডা হাওয়া লাগে, নারীদের শরীরও ঠিক তেমনভাবে গরম অনুভব করে, তাদের শরীরও চায় একটু ঠাণ্ডা হাওয়া পেতে। কারণ তাদের শরীর ও রক্ত-মাংস, চামড়া দিয়ে তৈরি। কিন্তু তারা তা করতে পারে না, কারণ সমাজ তা ভাল চোখে দেখে না।

পুরুষরা দেশীয় পোশাক ছেড়ে পশ্চিমা পোশাক বেছে নিয়েছে চলাফেরার সুবিধা আর পরতে সুবিধা হওয়ার খাতিরে। কিন্তু নারীদের পরতে হয় দেশীয় পোশাক বা নির্দিষ্ট করা কিছু পোশাক, যা মোটেও আরামপ্রদ নয়। প্রচণ্ড গরমে ঘরের ভিতর পুরুষ যখন গায়ের জামা খুলে ফেলে, সেখানে নারীরা শুধু টি-শার্ট পরে থাকার অধিকারও রাখে না ঘরে পুরুষ আছে বলে, আর সে পুরুষরা নিজের বাপ, ভাই হওয়া সত্বেও। নারীরা ঘরেও সেই গরমের মধ্যে ঘামে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে শরীরে ঘামাচি জন্ম দিয়ে জামার উপর আর একটা বাড়তি কাপড় পরে থাকে।

রাস্তায় শরীর চর্চার জন্য পুরুষ দৌড়াতে পারে, ব্যায়াম করার উপযুক্ত পোশাক পরে। কিন্তু নারীদের জন্য ব্যায়াম এর উপযুক্ত পোশাক পরার কোন সুযোগ নেই, দৌড় তো দূরের কথা। তারা ভারী জামাকাপড় পরে হাঁটে, আর এই হাঁটার গতিও একটা নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে থাকে। ব্যায়ামের উপযুক্ত জামাকাপড় না পরলে তা সঠিকভাবে করা সম্ভবও নয়।

এসব বিষয় পুরুষরা বুঝে না, বা বুঝতে আগ্রহী না। তবে  তাদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না। নারীকে শুধু নারী না মনে করে যদি মানুষ মনে করা হতো, তাহলে তারা বুঝতে পারতো। কৈশরে খেলতে না পারা, দৌড়তে না পারা, পড়তে না পারা, মন খুলে হাসতে না পারা, নিজের পছন্দের কাজ করতে না পারা, সারাক্ষণ ঘরে আবদ্ধ থাকা, একটু তাজা বাতাসে নি:শ্বাস নিতে না পারা, বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যেতে না পারা, তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে না পারা, নিজের জীবন শুরু হওয়ার আগে অন্যের জীবন সুন্দর করার জন্য একজন মানুষকে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া, এগুলো একজন মানুষের জন্য কতটা কষ্টের, তা একজন মানুষ মানুষ হওয়ার কারণে অবশ্যই বুঝতে পারে, শুধু বুঝতে পারে না তখনই, যখন এই কষ্টগুলো কোন নারীর হয়। 

তারা ভাবে না নারীদের নিজস্ব কোন চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে। তারা ভাবে, সব নারীই এসব মেনে এসেছে, এসব মানা যদি কষ্টের হয় তাহলে অতীতে নারীরা বা বর্তমান অনেক নারী এসব কেন মেনে নিচ্ছে!

অতীতে তো অনেক নিয়ম ছিল। অনেককিছুই মানুষ বাধ্য হয়ে মেনে চলতো। কিন্তু কিছু মানুষ সেই অবিচারগুলো মানতো না বলেই যুগে যুগে অধিকার আদায়ে অনেক আন্দোলন করেছে, অধিকার আদায়ও করেছে। তাই বলে অতীতে কিছু মানুষ অন্যায় মুখ বুঁজে সহ্য করেছে বলে তা কি সঠিক ছিল? একসময় নারীদের পড়াশোনা করা অনর্থক ধরা হতো, আরবে কন্যা শিশু জীবন্ত পুঁতে দেওয়া হতো, ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল, প্রচুর বাল্য বিবাহ হতো এবং নারীরা তা না বুঝে মেনেও নিত। তাই বলে কি নারীদের পড়াশুনা করা সত্যিকার অর্থে অনর্থক ছিল? কন্যা শিশুদের মেরে ফেলা, বাল্য বিবাহ, সতীদাহ প্রথা কি সঠিক ছিল?

একজন নি:সঙ্গ মায়ের কষ্ট কতোজন সন্তান বুঝতে পারে? মা-বাবার ছাড়াছাড়ি বা বাবা মারা যাওয়ার পর কতজন সন্তান অনুভব করতে পারে, তার মা শুধু তারই মা। এছাড়া সে একজন মানুষ, তারও সঙ্গীর প্রয়োজন হতে পারে। তারও অনেক ধরণের চাহিদা থাকতে পারে। বাবার সঙ্গী চাওয়ার ব্যাপারটা অনেকে স্বাভাবিকভাবে দেখে, কারণ এটা প্রচলিত রয়েছে সমাজে। মায়েরও যে মানুষ হিসেবে নিজস্ব একটা জগত আছে, এটা অনেক সন্তানই বুঝতে চায় না। অনেক মা নিজেও সমাজের বাঁধাধরা নিয়মকে মেনে নিয়ে নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা জানায় না। কিন্তু সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও মাকে বুঝতে পারে না। এর কারণ মা একজন নারী, নারীরও অধিকার আছে নিজেকে মানুষ ভাবার, সমাজ তা মানতে চায় না। এই পুরুষশাসিত সমাজে ” মা”কে ফেরেস্তার আসনে বসিয়ে তার মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়।

লোকে বলে নারীর মর্যাদা অনেক। নারীর মর্যাদার নাম যদি হয় অমানুষিক পরিশ্রম করা। যদি হয় নিজের চাওয়া পাওয়া, সকল সু্যোগ সুবিধা, শান্তি, আর নিজেকে বিসর্জন দেওয়া। তাহলে ওই মর্যাদার কোন প্রয়োজন নেই।

শেয়ার করুন: