জেসমিনা হক:
এবারের নারী দিবসের শ্লোগান ছিল “BE BOLD FOR CHANGE”. এই যে পরিবর্তন, তা তো হচ্ছেই এবং হবে। সময়ের প্রয়োজনেই আমরা পরিবর্তিত হই। পরিবর্তন হয় আমাদের ভাবনার। তবে পরিবর্তনের আরো একটা কারণ আছে, তা হলো প্রতিটি মানুষই নিজে যে কারণে কষ্ট পেয়েছে, সে তার ভালবাসার মানুষটিকে সেই কষ্ট পেতে দিতে চায় না, তাই সে পরিবর্তন আনতে চায়।

আমার ক্ষুদ্র ভাবনায় আমি দেখি, আমাদের মেয়েবেলা যেভাবে কেটেছে, আমরা চাই “আমার মেয়ের মেয়ে বেলা” সেভাবে না কাটুক যদি তা কষ্টের হয় আমাদের কাছে। তাই নিজে যা পারি নাই, সচেতন মা হিসেবে তাকে সেটা পারতে শেখাই। কিন্তু একটা প্রশ্ন বার বারই মনে উদয় হয়, সব শেখাতে শেখাতে আসল শক্তিটাই তাকে শেখাতে ভুলে যাই, তা হল মানসিক দৃঢ়তা, মানসিক জোর!!
প্রজন্মের সময়ের তুলনা করলে আমাদের সমাজে মেয়েরা আগের চেয়ে ভালো জীবনযাপন করছে। চার দেয়ালে বন্দি জীবন, রান্না ঘরেই সারাদিন কাটানো, পারিবারিক বিষয়ে নিজের কোনো অবস্হান না থাকা —- এই কথাগুলো এখন কম দেখা যায়। নারী গৃহিণী হোক বা কর্মজীবী, পরিবারে এবং সমাজেও তার একটা অবস্থান কিন্তু তৈরি হয়েছে। এই অবস্থানটা কন্টকমুক্ত আর দৃঢ় করার প্রয়াস চলছে এখন। যে অবস্থান তৈরি হয়েছে পরের প্রজন্মের নারী যাতে আরো একটু স্বস্তি নিয়ে অবস্থান করতে পারে সেটাই এখন চাওয়া।
যেটা বলছিলাম মানসিক জোর! জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেবে আগের প্রজন্মের নারীরা যে কতটুকুই পেতেন তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু তারাও আত্মহননের পথ খুব বেশি বেছে নিতেন না। আমাদের পরের প্রজন্মের মানসিক জোর কি তাহলে তাদের চেয়ে কম? অধিকারের কথা শেখাতে শেখাতে আসল যে মন্ত্র “জীবন একটাই আর মহামূল্যবান” আর “ভালোবাসো নিজেকে” এই কথাগুলোকে কি আমরা আমাদের সন্তানদের শেখাতে ভুলে যাচ্ছি?
পারিবারিক বন্ধুত্বপূর্ণ রিলেশন এখন আগের চেয়ে বেশি দেখা যায়। তবে হ্যাঁ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কর্মব্যস্ত বাবা-মায়ের সন্তানেরা একাকিত্বে ভোগে। কিন্তু যে বয়সী বাচ্চারা আত্মহত্যা করে সেই বয়সে তাদের একটা নিজস্ব জগত তৈরি হয়। একান্ত নিজের জগত। পরিবারের সদস্যদের ভালবাসা ফিকে হয়ে যায় রোমান্টিক ভালবাসার কাছে। তাই তো প্রেমিক বা প্রেমিকার বিরহে যখন কেউ আত্মহত্যা করে, আর যারা তাকে ভালবাসে তাদের কথা তার মনেও পড়ে না। আসলে রোমান্টিসিজম প্রয়োজন জীবনে, কিন্তু এটাই সবকিছু নয়।
সন্তানকে অধিকারবোধের পাশাপাশি জীবনবোধ ঠিকমতো শিখতে দেয়া হয় না। বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলো যখন ষোল আনা পূর্ণ হয়, মানসিক চাহিদার অপূর্ণতায় জীবন তখন তুচ্ছ মনে হয়। জীবনের অধিকারবোধের পাশাপাশি জীবনের দায়টাও যেন আমাদের সন্তানদের আমরা শেখাই।
“আমার জীবন আমারই। আমার চলার পথে যদি সুযোগ্য সাথী মেলে তবে পথ চলার মধুরতা খানিকটা বাড়ে। কিন্তু আমি তো পঙ্গু নই যে পথ চলার সাথী না পেলে জীবন আমার মুখ থুবড়ে পড়বে। আমি যখন নিজেকে মানুষ ভাবি, মানুষ হিসেবে জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি, আমার পরিবারের প্রতি অনেক দায় আছে আমার। একজনের ভালবাসা পেলাম না, তাই বলে আমার অন্যান্য দায়িত্বগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কি চলবে?
সবার আগে ভালবাসো নিজেকে। যে নিজেকে ভালবাসে সেই পারে অন্যকে ভালবাসতে। নিজেকে ভালবাসা আর স্বার্থপরতা কিন্তু এক নয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অনেক অনেক কারণ আছে। আমরা সবাই হয়তো নক্ষত্র হতে পারি না, কিন্তু যার যার জায়গায় আলোকিত মানুষ অবশ্যই হতে পারি”।
তুমি যেই হও নারী বা পুরুষ, জীবন তোমার হলেও জীবনের জন্য তোমার যে দায় —-তোমার পরিবার, তোমার সমাজ, তোমার চেয়ে তুলনামূলক বঞ্চিত (মৌলিক চাহিদা) মানুষগুলোর প্রতি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। মৃত্যু যখন আসবে আসুক, কিন্তু স্বেচ্ছায় তাকে আলিঙ্গন করো না। তোমার জীবন তোমার মায়ের কাছে, তোমার বাবার কাছে তো অমূল্য। মেয়ে, তুমি নিজেকে মানুষই যদি ভাবো, তবে তোমার দায়গুলো পূরণ কর। একজনের জন্য সবার দায় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। বেঁচে থাকো, জগতে বেঁচে থাকার অনেক অনেক মূল্যবান কারণ আছে ।
চলুন, আমাদের সন্তানদের যেন সঠিকভাবে নিজেকে ভালবাসতে শেখাই আমরা। অধিকার বোধের পাশাপাশি মানসিক জোর থাকাটা বড় বেশি প্রয়োজন। তবে শুধু মেয়ে নয়, ছেলে সন্তানদের প্রতিও কথাগুলো বর্তায় । শুধু প্রেমিক বা প্রেমিকা কেন, সারাজীবন একসাথে চলার মানসিকতা নিয়ে যে বিয়ে হয় সেই মানুষটাও তো অনেক সময় বদলে যায়! একসাথে হয়তো আর পথচলা হয় না। তাই বলে কি থমকে যাবে জীবনের পথচলা? আমার জীবনের পথ আমি চলবো। ভালো থাকুক সবাই, ভালো থাকার দৃঢ়তা নিয়ে।