নাহিদ খান:
এক – মীরা একটা বিদেশী উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে, বরিশালে পোস্টিং। সুন্দর ছিমছাম একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে, ঢাকার মতোন খরচ নেই বরিশালে, আর্থিক একটা জোর তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রায়ই কিছুদূর গাড়িতে, কিছুদূর নৌকায়, কিছুটা পায়ে হেঁটে সে গ্রাম গ্রামান্তরে যায়। গ্রামের মহিলাদের নিয়েই তার কাজ, এই দুহাজার সতের সালেও গ্রামে সে ডাব, কলা, বরই দিয়ে আপ্যায়িত হয়। ফেরার সময় ভর সন্ধ্যায় মাঝ নদীতে মীরার মন ভালোলাগায় ছেয়ে যায়। বড় শান্তির, পরিপূর্ণ একটা জীবন তার।

কিন্তু পরিবার-স্বজন-বন্ধুদের কাছে মীরা একজন ব্যর্থ, অসফল, দুঃখী মানুষ। চল্লিশোর্ধ নারী একলা মফস্বলে পড়ে থাকে এরচে বড় দুঃখ বা ব্যর্থতা আর কীই বা হতে পারে। তারা অনেক গল্প খোঁজে, প্রেমে ব্যর্থতা বা আরো গভীর গোপন কিছু। মীরা আগে বোঝানোর চেষ্টা করতো, আরে বাবা একজন মানুষের এক্কেবারে অকারণেও ইচ্ছে করতে পারে একলা থাকার, শহরের কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে থাকার, এর পেছনে কোনো গল্প নেই। এখন আর চেষ্টা করে না, সে বরং এজাতীয় সহানুভূতির সামনে বেশ দুখী দুখী একটা মুখ করে ভেতরে ভেতরে হাসতে থাকে!
দুই
নিশাত, মীরার বন্ধু, সমাজের মাপকাঠিতে সুখী ও সফল নারী। সে ঢাকায় একটা ধাঁ চকচকে অফিসে কাজ করে, গ্রামের মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো বিশ্রী বিষয়ের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তার বর আরো বড় একটা চাকরি করে, এবং তাদের দুটো ছেলেমেয়ে আছে। ব্যস, নিঃসন্দেহে উপসংহার টানা যায় যে নিশাত একজন সুখী মহিলা!
কিন্তু গোল বাঁধে যখন নিশাত আচমকা কোনো কোনো সন্ধ্যায় মীরাকে ফোন করে। মীরা তখন হয়তো মাঝ নদীতে, ঘরে ফিরছে। নিশাত জিজ্ঞেস করে- তুই কইরে?
- এক্কেবারে সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে আমি এখন সন্ধ্যা নদীর বুকে!
- ঈশ… তুই ধানসিঁড়ি দেখেছিস?
- দেখেছি, অত আহামরি কিছু না…
তারপর নিশাত জানতে চায়- মীরা তোর বাসায় ক’টা রুম?
- দু’টা বেডরুম, আর ড্রয়িং, ডাইনিং এগুলো তো আছেই…
- শোন আমি না একদিন হুট করে চলে আসবো, একা, তোর ওখানে…
- আয় না, খুব ভালো হবে, একটা রুমে ম্যাট্রেস পেতে রেখেছি, বুকশেলফও সেখানে, তুই পড়বি, লিখবি…
- হুম আমি লিখবো, কট কিছু জমে গেলে লেখার, আমি আসবো, একা।
নিশাত ফোন রেখে দেয়, মীরা অতীত ঘাঁটে কিছুক্ষণ। কী পড়ুয়া ছিল এই নিশাত, আর লেখালেখির নেশা ছিল। দু’চারটা ছেলেকে দেখলেও মীরা এমন আপাদমস্তক কবিতা আর সাহিত্যে পাওয়া মেয়ে আর কাউকে দেখেনি। নিশাত নিশ্চয়ই আর লিখে না এখন, কিন্তু পুরনো নিশাত এসে মাঝে মাঝে হাজির হয় হয়তো, তখন সে পাগলের মতো মীরাকে ফোন করে বলে- আমি একলা আসবো একদিন…।
মীরার মন বিষাদে ছেয়ে যায়। সুখী মানুষের তকমা লাগানো নিশাত কী ভয়ংকর দুঃখী।
মীরা মনে মনে বলে আহারে মেয়েটা, আহারে…