ত্যাগে নয়, অর্জনে বাঁচো মেয়ে

ফারজানা নীলা:
বুঝ হওয়া পর থেকে জীবনের প্রতি পদে পদে কত শত ত্যাগ আর মেনে নেওয়ার পর্ব পার করতে হয় মেয়েদের তার হিসেব নারী নিজেরাও রাখেনা বোধ হয়। যখন সে  একটু বড় হয় শিখতে শুরু করে মেয়েদের “এই করতে নেই ,সেই করতে  নেই” । রপ্ত করতে হয় কীভাবে নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়।  
পথে ঘাটে বখাটের দ্বারা অথবা ঘরের ভেতর কোন স্বজন দ্বারা লাঞ্ছনার শিকার হলে  বাবা মা’ই  নির্দোষ মেয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়,  “চুপ থাকো কাউকে বোলো না, নইলে মানুষ মন্দ বলবে” ।  চুপ থাকাও একটা শিক্ষা,  বেশি কথা বললে মেয়েদেরই ক্ষতি!
ফারজানা নীলা

চাপিয়ে দেয় বাড়তি পোশাক, হিজাব বোরকার চাপ।  পুরুষরা তাতে  মেয়েদের  ভদ্র নম্র পর্দানশীন বলে প্রশংসা করে। একটু ভেবে দেখো, তোমাকে বোরকা হিজাব পরতে কেন বলছে? তোমাকে দেখলে তাদের মাথা গরম হয়, মুখে নাকি লালা আসে। তারা  দৃষ্টি সংবরণ করতে না পেরে তোমার উপর পোশাকের ব্যারিকেড দিয়েছে।

ধর্ষণে শিকার নারী যদি বিচার চায় তবে কত ভাবেই না তার এই চাওয়ার পায়ে শিকল পরায়। ধর্ষকদের পক্ষ থেকে হুমকি তো আছে পাশাপাশি পরিবারও চায় ঘটনা যেন ধামা চাপা পড়ে যায়। হায়! কেউ অনুমানও করতে পারবেনা, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এমন নিকৃষ্ট অন্যায়ের বিচার চাইতে না পারার অসহায়ত্ব কী ভয়াবহ। কেন চাইবে না সে বিচার? লোকে জানবে, লোকে নিন্দা করবে, লোকে মেয়েকে দোষ দিবে। ধর্ষিত হয়েছে মেয়ে, আর মানও যায় মেয়ের।
 অধিকাংশ বাবা মা চায় একটা নুন্যতম শিক্ষার পড়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে। “উচ্চশিক্ষা বিয়ের পর, স্বামী চাইলে” । মেয়ের ইচ্ছে চাহিদা স্বপ্ন নির্ভর করে  স্বামী আর শ্বশুর বাড়ির উপর। স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। “এতেই মেয়ের ভাল” , “শশুর বাড়ি আসল ঠিকানা” এই বোধের সাথে সমঝোতা করে!
বিয়ের পর যদি বনিবনা না হয়, বৈবাহিক জীবন যদি অতিষ্ঠ হয়ে যায় তবুও তাকে শুনতে হয় “মেয়েদের একটু মানিয়ে চলতে হয়” “সংসারে এমন একটু হয়, মেয়েদের সহ্য করে চলতে হয়” । মানিয়ে নিতে নিতে হয়ত ভেতরে নিষ্প্রাণ হয়ে যায় তবুও তার আপ্রাণ চেষ্টা সংসার টিকিয়ে রাখার। সে যে মেয়ে, তাকেই তো টিকিয়ে রাখতে হবে, নইলে নারী হওয়ার সার্থকতা কোথায়!
সন্তান ধারণ করা নাকি নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনপ্রাণীজগতের সকল স্ত্রীলিঙ্গ যে কাজ প্রাকৃতিক ভাবে করে আসছে সে কাজ নারী জীবনের সেরা কাজ হয়ে যায়।   জন্মদানের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে লালন পালনের সময় নারীকে কি কি সহ্য করতে হয় সেই হিসেব না হয় নাই দিলাম। আর সন্তানের নামের শেষে পারিবারিক নাম জুটে বাবার। এই সার্থক কাজ করতে গিয়ে যদি তাকে তার ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয় তবুও কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। সন্তানের চেয়ে যে নারী তার ক্যারিয়ারকে গুরুত্ব দেয় সে মা না ডাইনী! তাহলে উপায়? চাকরি ছাড়ো। নারী হয়েছ যেহেতু সেহেতু ত্যাগ আর বিসর্জনই তোমার জন্মগত গুন। আবার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নারীরা স্বামীর অনেক শারীরিক মানসিক শোষণ মেনে নেয়। হায় ! মাতৃত্বের কাছে যে নারী সত্ত্বা  খুন হয়!
নারী মহান, নারী উদার, নারী ধৈর্যশীল নারী সংযমী নারী আত্মত্যাগী! আহা! নারীরও কান জুড়ায় এমন বিশেষণে, এমন সম্মানে নিজেকে তখন অনেক গর্বিত মনে হয় তাই না? চোখে মুছে হাসি মুখে সায় দেয়, মনে মনে অহংকারও করে, “হ্যাঁ আমি যা পারি পুরুষ তা পারে না, পুরুষের এত সহ্য ক্ষমতা নেই”
থামো বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা নিয়ে অহংকারে মাথা উঁচু করার আগে একবার মাথা খাটিয়ে ভাবো ত্যাগ করা, সহ্য করা  তোমার গুন বা  যোগ্যতা না বরং অযোগ্যতা। ভেবো না এসব বিশেষণ দিয়ে পুরুষরা তোমাকে মাথায় তুলছে। তোমাকে মহান বলছে তার পিছনেও রয়েছে তাদের স্বার্থ নারী ধর্ষণের বিচার না চাইলে পুরুষের  সুযোগ হয় আরেকটা ধর্ষণের। অন্যায় মেনে নিলে স্বামীর সুযোগ হয় বাইরে আরো ফুর্তি করার, ঘরে যা খুশি করার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইভ টিজিঙের প্রতিবাদ না করলে বখাটেদের সুযোগ হয় আরও উত্যক্ত করার। সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব পুরোটা মায়ের উপর ছেড়ে দিলে বাবাদের সুবিধা হয় গায়ে হাওয়া লাগাবার।  
পুরুষকে যদি বলো চাকরি ছেড়ে সন্তান দেখাশুনা করো। সে পারবে না। কারণ শুধু এই কাজ করে সে সন্তুষ্ট হবে না। সে জানে সন্তান  জন্মদান, দেখাশুনা করা  তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য না। আর যে সন্তানের দিকে তাকিয়ে স্বামীর অন্যায় মেনে নিচ্ছো, সেই সন্তানও কিন্তু এমন পরিবারে সুখী হয় না। বরং সাহস করে  যদি প্রতিবাদ করতে তবে বড় হয়ে সন্তান বুঝতো তুমি তোমার সম্মানের জন্য হার মানো নি।  
আর কত ত্যাগ, আর কত বিসর্জন আর কত ধৈর্য ধরবে। আর কত বোকা হয়ে থাকবে? কবে বুঝবে এসবই পুরুষের চালাকি তোমাকে শোষণ করার, দমিয়ে রাখার, তোমাকে উপরে  উঠতে না দেওয়ার, তোমাকে মহান বানিয়ে  তোমার সাথে যা খুশি করার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার।  নিজের সুখের জন্য শক্ত হও, নিজের অস্তিত্বের জন্য একটা পরিচয় খুঁজো। সহ্য না করে প্রতিবাদ করো, চিৎকার করো, বিচার চাও। এমন কিছু করো যেখানে তোমার মেধা বুদ্ধি শ্রমের  বিকাশ ঘটবে। সেখানেই তোমার আসল অহংকার।
মেয়ে বোন স্ত্রী মা এগুলো সম্পর্ক, অর্জন না। এসব উপাধি দিয়ে তোমাকে মহান বানাচ্ছে বিনিময়ে তোমার থেকে তোমার নিজস্বতা আর সাহস কেড়ে নিচ্ছে। সম্পর্কের বাইরেও তোমার একটা সত্ত্বা আছে। সেটাই তোমার আসল পরিচয়। সেই পরিচয় খুঁজে পাওয়াই অর্জন। এবার একটু সাহসী হও মেয়ে!
শেয়ার করুন: