ঘুরে দাঁড়াবার দায় আছে! শুভস্য শীঘ্রম!

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা:

“ছেড়ে দিলে কেন? কষে দুটো চড় লাগাতে পারলে না?” কখনো আমরা অন্যকে বলছি, আবার কখনো সেই আমরাই একই পরিস্থিতিতে ভুগে অন্যের কাছে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি! এই প্রশ্ন করা কিংবা শোনা উভয়ই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবান্তর!

বলছি যৌন হয়রানির কথা চলতে-ফিরতে-উঠতে-বসতে লিঙ্গীয় পরিচয় ভিত্তিক হয়রানি ও নিপীড়নের কথা। দ্বিধা কাটিয়ে উঠতেই নিজের অবস্থানটুকু প্রকাশ করার সুযোগ ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলি আমরা এক্ষেত্রে শুধু নারী নয়, নারীর আশপাশে বা সঙ্গী হয়ে আছে যে পুরুষ, সেও প্রাসঙ্গিক। যে পুরুষ এখনো কৈশোর পেরিয়ে উঠতে পারেনি বা শারীরিক ও মানসিক গঠনের কারণে সমাজের চোখে ‘পুরুষ’ স্বীকৃতি পেয়ে ওঠেনি, সেও।

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা

জীবনে কতোবার এ ধরনের হয়রানির স্বীকার হয়েছি সে নিয়ে আলাদা বই লেখা যাবে (সব যে মনে রেখেছি তাও নয়)। অথচ এমন নয় যে আমি এ সমাজে ব্যতিক্রম কেউ। তাহলে? প্রতিনিয়ত কেন আমরা প্রতিবাদ দেখি না? সাহসের অভাব? সব সময় নয়। ইচ্ছের অভাব? কদাচিৎ। নিজের গায়েই দায় এসে পড়ার (ভিক্টিম ব্লেইমিং) ভয়? এর তোয়াক্কা যিনি করেন না তিনিও যে সব সময় প্রতিবাদ করে উঠতে পারেন তাও কিন্তু নয়। তাহলে ঘটছেটা কী? ঘটনায় যে না পড়েছে তার পক্ষে বোঝা দুষ্কর; এমনকি নিজেকে আর নিজের ভাবনাগুলোকে লক্ষ্য না করলে যে পড়েছে তার পক্ষেও এই আচরনের ব্যাখ্যা বোঝা ভার।

ঘটনাগুলোর অনেক রকম হয়।

প্রথমতঃ এতো সন্তর্পণে এবং সাবলীলভাবে ঘটনাটা সে ব্যাক্তি ঘটিয়ে যাবে যে আপনার পাশের ব্যক্তি বা তার নিজের পাশের ব্যক্তি তো দূরের কথা, আপনি নিজেও ধাঁধাঁয় পড়ে যাবেন, “আমিই ভুল বুঝিনি তো?” এক্ষেত্রে সে “চোরের মায়ের বড় গলা” (প্রবাদ ব্যবহার করেও স্বস্তি নেই, যে কোনভাবেই হোক দোষটা নারীকে দিতে এ সমাজের কার্পণ্য নেই)পদ্ধতিতে আপনাকেই উল্টো ঘায়েল করে দিবে এবং পূর্ণ সহযোগিতা পাবে তার পাশের, এমনকি অনেক সময় আপনার পাশের ব্যক্তিটির কাছ থেকেও! কারণ তারা তো একেবারেই কাছে ছিলেন, কই তারা তো টেরটি পাননি!অথবা আপনি ঘটনা বুঝতে পারলেও নিশ্চিত নন এতোজনের ভীড়ে কে এই দুরাচার। কিংবা হয়তো বুঝতে আপনি পেরেছেন স্পষ্টই, কিন্তু ঘটনার আকষ্মিকতায় প্রতিক্রিয়া জানাতে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ফেলেছেন, ততক্ষণে সে পগার পার!

এসব ক্ষেত্রে করণীয় আছে অভিযুক্তের পাশের ব্যক্তির এবং আপনার পাশের ব্যক্তির। করণীয় হলো, এমনটা যে ঘটে থাকে তা এক্ষুনি জেনে রাখা। পথে-ঘাটে কখন আপনি কার পাশের ব্যক্তি আপনি জানেন না, কিন্তু যার পাশেই থাকুন, আপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অজ্ঞতা আর অসচেতনতা যৌন হয়রানির প্রতিবাদ না হবার এবং অনেকের ঘরমূখী হয়ে ওঠা ও গুটিয়ে থাকার প্রধান কারণ।

আর যদি আপনি স্বয়ং ঘটনার শিকার হন, সেক্ষেত্রে মূল করণীয় হলো এসব মাথায় একদম না রেখে বিন্দাস চলাফেরা করা। মোক্ষমরূপে হাতে পেলেন তো এক চুল ছাড় নাই, আর যদি তা না পান তো এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের কাজ বা গন্তব্যে মন দিন। কোথাকার কোন ছার এসে বিশেষ কলাকৌশল রপ্ত করে তা খাটিয়ে গেছে অচেনা একটা মানুষকে ছুঁয়ে বা দুটো কথা শুনিয়ে মজা নেওয়ার জন্য, তার চেয়ে পৃথিবীর অন্য যে কোনো কিছুই আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দয়া করে একে এত গুরুত্ব দিবেন না যেন এই ব্যক্তির হাতেই ছিলো আপনার পবিত্রতার চাবিকাঠি যার বলে সে আপনাকে কলুষিত করে গেছে!

দ্বিতীয়তঃ এমনও হয় ঘটনার শিকার ব্যক্তি স্পষ্টতই জানেন কে তাঁর সাথে কী করলো এও জানেন এটা স্পষ্টতই যৌন নিপীড়ন ঘটনা যা ঘটেছে যদিও তাতে মরমে মরে যাওয়ার কথা দোষী ব্যক্তির, কিন্তু সেই দায়িত্ব পুরোটাই নিপীড়নের শিকার ব্যক্তি নিয়ে ফেলে মরমে মরে যেতে বসেছেন, কী করে এমন ব্যাপার মুখে উচ্চা্রণ করা যায় সে উপায়ও তার জানা নেই (আমাদের সমাজ খুব সূক্ষ্মভাবে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে ক্রমাগত গেঁথে গেছে ভুল প্রতিক্রিয়া। লজ্জাকে জড়িয়ে রেখেছে শরীর আর স্পর্শের সাথে, যেখানে লজ্জার সম্পর্ক হওয়া উচিত অন্যায়-অবিচারের সাথে)!

এক্ষেত্রে করণীয় কিছুটা চর্চার বিষয় নিজেকে খোলসের ভেতর থেকে সচেতনভাবে বের করে আনতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, এসব ক্ষেত্রে চুপ থাকা বা এড়িয়ে যাওয়া মানেই এই ব্যক্তিকে অন্য কারো সাথে একই আচরণ করতে সুযোগ করে দেওয়া। এবং সেই পরবর্তী জন হতে পারে আপনার চেয়েও নাজুক কেউ, যার পক্ষে কখনোই জানা সম্ভব নয় যে এই হয়রানি/নিপীড়ন তার লজ্জা নয়, ঐ ব্যক্তির লজ্জা

তৃতীয়তঃ পরিবারের সদস্যদের দ্বারা যৌন নিপীড়ন। এমনটা হতে পারে ঘরে, আত্মীয়ের (শব্দটা শুনতে ‘আত্মার সাথে সম্পর্কিত’ মনে হলেও আসলে আমাদের কাছে এর অর্থ ‘জন্ম বা পারিবারিক সূত্রে সম্পর্কিত’, কথাটা মাথায় রাখা প্রয়োজন!) বাসায় কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠান বা কেনাকাটায় যাত্রাপথে

এই প্রতিবাদ কঠিন, এই জন্য নয় যে ভুক্তভোগীর উপর উল্টো দোষ আসতে পারে। সাহস বা সময়ের অভাবেও এই প্রতিবাদ চাপা পড়েনা। এটা দুষ্কর কারণ যার বিরুদ্ধে আপনি যাবেন তার সাথে আপনার কাছের মানুষদের ভালোবাসা, বিশ্বাস, আস্থা, এবং অনেক সময় জীবন-জীবিকা-ভবিষ্যৎ জড়িত। তাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই কাছের মানুষগুলির সাথে নিপীড়নকারীর নিবিড় সম্পর্ক। কারণ এই প্রতিবাদে পরিবারের কিছু মানুষের জীবনে ঝড় আসবে (হয়তো আমরা জানি এই প্রতিবাদ তার জন্যেও মঙ্গল কারণ এই ভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসা তার জীবনকেও সজীব করতে পারে)।

এই ঝড় মোকাবেলা করার বা কষ্টটাকে সামাল দেওয়ার শক্তি এই কাছের মানুষগুলির আছে কি নেই সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনা, ঠিক ভরসা করে উঠতে পারিনা (ফাঁকতালে বেঁচে যায় দুরাচার)। সব বাধা ভেঙ্গে দুর্বার কাঁপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই থাকে (এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করার শক্তি যার আছে তাঁকে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা জানাই) অথচ চেপে যাওয়া আর দিনের পর দিন এই দুরাচারের সাথে ‘স্বাভাবিক’ আচরণ চালিয়ে নেওয়ার পাষাণ ভার বয়ে বেড়ানোতে আমরা কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই! বড়ই বিচিত্র জীব আমরা!

সবার সবকিছু পারতে হবে এমন নয়। কেউ প্রতিবাদ করতে পারে বলে সবসময় তারই সরব হতে হবে এমনও নয়। প্রতিনিয়ত প্রতিবাদী হতে গিয়ে আমার জীবনটাকে উপভোগ করারই ফুরসত পাবোনা তা-ও নয়।

কিন্তু ঘুরে দাঁড়াবার দায় আছে। কখনো না কখনো, নিজের অথবা অন্যের জন্য- ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেবার দায় আমাদের প্রত্যেকেরই আছে। দৃঢ় প্রতিবাদ আর দৃপ্ত পদচারণায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথ সুগম করার দায় আছে।

শুভস্য শীঘ্রম!

০৭ মার্চ ২০১৭

শেয়ার করুন: