একা নারীর সকল যুদ্ধই কীর্তির

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী:

স্কয়ারগ্রুপ যেদিন এবারের নারী দিবস উপলক্ষে কীর্তিমতী নারী হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার খবরটা আমাকে দিলো, নিজের ভেতর কোথায় যেন একটা উচ্ছাস অনুভব করতে থাকলাম। এমন সময়  ফোনটা বেজে উঠলো আমার। আমার কন্যার ফোন। উচ্ছাস নিয়েই তাকে খবরটা দিলাম। বুঝলাম সেও যথেষ্ট খুশি। তারপর ছেলেকে ফোন করলাম। চাপা স্বভাবের হলেও খুশি বোঝা গেল তার কথায়ও। সেও অভিনন্দন জানালো। ওইটুকুই।

আর কাউকে খুঁজে পেলাম না যাকে এই আনন্দ শেয়ার করা যায়। নিজেকে নিজেই বলতে থাকলাম কী অভাগা আমি! ছেলেমেয়েদের বাইরে তো আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় দাবিকারী অনেকে আছে। তাদের কাছে যদিও জীবনের কোনো দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করাতে পারিনি আমি কোনদিন, আজ এমন দিনে একটা আনন্দের খবরও তাদের শেয়ার করতে পারছি না।

যদিও খবরটি শুধু আমার জন্যই আনন্দের। তাদের জন্য নয়। স্কয়ার আমাকে কীর্তিমতী সাংবাদিক হিসেবে সম্মাননা দেবে। আমার পরিবার তো আমার সাংবাদিকতাকে প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করে। ঘৃণিত কোন কাজে সফলতা মানে তো অধিকতর ঘৃণার। আমার এই খবর তাদের কাউকে ন্যুনতম ভাললাগা দেবে না, দেবে যন্ত্রণা। তাই আর কাউকেই খবরটা দেয়া হলো না।

সাংবাদিকতা যখন শুরু করি সামাজিকভাবে আমি যেন একটা নিকৃষ্ট কাজ শুরু করেছি এমন আচরণের মুখোমুখি হই সবখান থেকে। জেলা শহরের একটা একলা মেয়ে একা একা যেখানে সেখানে ছুটে বেড়ায়। ভালো-মন্দ, গরীব-ধনী, জাত-পাতের তোয়াক্কা না করে সবার সাথে সমানভাবে মিশে যায়। রাত-দিনের কোনো হিসেব করে না। এমন মেয়ে মানুষ তো সমাজের জন্য হুমকি। তাকে দমিয়ে দেওয়া হোক। বাজে কথা বলে বলে, লাঞ্ছনা দিয়ে দিয়ে ঠেকানো হোক। মামলা-হামলা কিছুই বাদ দেয়নি তারা। সেদিনও সমাজ আমাকে দমাতে পারেনি। পেরেছে আমার পরিবারকে আরো বেশি বিষিয়ে দিতে। আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি পরিবার থেকে। একটার পর একটা সম্পর্ক থেকে। তারা একবারও আমাকে বুঝতে চায়নি। যাচাই করে দেখেনি আমার বিরুদ্ধে রটানো অপপ্রচারগুলোর সত্যতা।

শুরু হয় আমার মা-বাবার পক্ষ থেকে চাপ। তাদের দাবি আমি যেন সাংবাদিকতাটা ছেড়ে দিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘরে ফিরে এসে গৃহদাসী হই! আমি অবাধ্য হই বাবা-মায়ের।

আমি যখন একটা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিউজ করে গোটা জেলায় একঘরে হয়ে যাই। আমার বিরুদ্ধে চারটি মানহানির মামলা হয়। একজন আইনজীবীও আমার পক্ষে দাঁড়াবে না বলে ঘোষণা দিয়ে বসে। আমি আমার পরিবারের একজন মানুষকেও আমার পাশে পাইনি। একজন সাংবাদিকও আমার পক্ষে ছিল না সেদিন। নিজের ভেতরের চাপগুলো ছোট দুই সন্তানকে বুঝতে দেইনি আমি। একা একা আদালতে যাই। হুম, সে সময় আমার সততা ও সাহস দেখে ২/১ জন আইনজীবী আমাকে সহায়তা করে। এটাই আমার জীবনের প্রথম জয় আমি বোধ করি।

মা-বাবা আমাকে সাংবাদিকতা ও কবিতা-গল্প লেখালেখির জন্য উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষ মনে করে। আমার ভাই-বোনেরা আমাকে ভাবে নষ্ট মানুষ। আমার বোন জামাইরা আর একটু সরস করে পিছনে আমাকে বেশ্যা বলেও গালী দেয়। আর আত্মীয়-স্বজনরা খারাপ মানুষের উপমায় আমার নামটি উচ্চারণ করে, যারা  বিপদে পড়লে আমার কাছে আসে আমি যেন সাংবাদিকতার অপশক্তি ব্যবহার করে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করি!

আর বাকি থাকলো আমার হাতে গোনা কিছু বন্ধু ও সহযোদ্ধা সাংবাদিক। যাদের আমি কাছের মানুষ মনে করি। তাদের ২/১ জনকে খবরটা দিতেই তারা যেন কষ্ট পেলো। কেউ কেউ যেন মনে করলো তাদের বাদ দিয়ে স্কয়ার কেন আমার মতো কাউকে এমন সম্মাননা দেবে! কেউ কেউ কষ্ট করে অভিনন্দন উচ্চারণ করলো মুখে , কিন্তু অন্তরে ব্যথা নিয়ে অচেনা হয়ে গেলো।

সালেহা ইয়াসমীন লাইলী

দিন ঘনিয়ে এলে স্কয়ারের টেলিভিশন মাছরাঙার একটি টিম আমার কাজের ডকুমেন্টারি করার জন্য কুড়িগ্রামে এলেন। টিম লিডার আমার সাথে আলাপকালে বললেন, গত ১৫ বছরে আপনার সাংবাদিকতায় অনেক পজেটিভ চেঞ্জ এসেছে। অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন হয়েছে। নিঃসন্দেহে আপনি অনেক ভালো ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু আমরা খুব ভালো সাংবাদিকতা করেছেন সেজন্য আপনাকে সম্মাননা দিচ্ছি না। আমরা আপনার জীবনের লড়াইগুলোকে তুলে আনতে চাই। দীর্ঘ দিনের এতো প্রতিকূলতাকে তোয়াক্কা না করে শুধু নিজের সাহসের জন্য পেশায় টিকিয়ে থাকা ও সফলতা অর্জনকে গুরুত্ব দিতে চাই।

আমি নিজের জীবনকে একবার রিভাইজ করতে শুরু করলাম তার কথায়। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার অমতে বিয়ে। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই সন্তানের মা। তারপর আরও এক সন্তান। তারপর অন্ধকার এক ঘরের বন্দি জীবন। সূর্যটা যেন আমার জন্য উঠতো না। ডাণ্ডাবেরি পরা নিদারুণ এক কারাবাসী আমি।

এই বাইরের যে জীবনটায় আজ আমি দাঁড়িয়েছি তার পুরোটাই আমার বিদ্রোহ। শেকল ছেঁড়ার লড়াই। একা একা দুইটি সন্তানের ক্ষুধা, নিজের ও তাদের পড়ালেখা ও পছন্দের ক্যারিয়ার বেছে নেয়ার যুদ্ধটা মোটেও সাধারণ ছিল না। তবু সাহস আমাকে পিছাতে দেয়নি। বেরিয়ে আসার বিদ্রোহ আমাকে গৃহহারা করেছে ঠিকই। সংসারহীন করেছে। পরিবার পরিজন থেকে করেছে বিচ্ছিন্ন। এটাতেও আমি নিজেকে ব্যর্থ ভাবি না। বরং তাদের দুর্ভাগ্য বলে নিজেকে প্রবোধ দেই।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দেয়াল আমার বিদ্রোহী চলার পায়ের আঘাতে টুকরা টুকরা হওয়াটা আমার অর্জন। সমাজে আমার অবস্থান আজ প্রতিষ্ঠিত। যে সাংবাদিক সহযোদ্ধারা এক সময় আমার বিরোধিতা করেছে, সেই সাংবাদিক সংগঠনে আজ আমি সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত। এটাও আমার অর্জন। আমার সন্তানরা তাদের পূর্ব পুরুষদের রক্তকে অস্বীকার করে আজ আধুনিক মানুষ হিসেবে বড় হয়েছে। এটা আমার সবচেয়ে বড় সম্মাননা।

নিন্দুকেরা যে যাই বলুক, আমি কীর্তিমতী কিনা জানি না, তবে আমি অনেক বেশি বিজয়ী। আমার এই বিজয়ের পথে সমর্থন জুগিয়েছে একমাত্র আমার সাহস। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যখনই কোনো নারীর জীবনে পারিবারিক সমর্থন থাকে তো সেই নারীর পক্ষে প্রতিষ্ঠা পাওয়া অনেক সহজ হয়। একা নারীর যুদ্ধটা সত্যিই কীর্তির।

লেখক ও সাংবাদিক   

শেয়ার করুন: