লিনা ফেরদৌস:
আসছে নারী দিবস, চারপাশে নারী দিবস পালনের খুব তোরজোড় চলছে। বছরের এই একটি দিনে নারীদের জন্য থাকে বিশেষ বিশেষ আয়োজন, প্রতিযোগিতা চলে কে কতটা বর্ণিলভাবে সাজাতে পারে বিশেষ এই দিনটিকে। নারীদের জন্য বিশেষ বিশেষ অফারে চারদিক সয়লাব– রেস্তোরা, সোনার দোকান, সুপার শপ, বিভিন্ন ব্রান্ডের আউট–লেটগুলোতে বিভিন্ন রকম আকর্ষণীয় ছাড়। এসব আকর্ষণীয় অফারে আমার চারপাশের অনেক মেয়েকে খুব খুশি হতে দেখে বেশ অবাক হই।

আমার এপার্টমেন্টের কোনো এক নারীর কান্না আমি প্রায়ই শুনি, সিঁড়ি ঘরে দাঁড়ালে শোনা যায় পুরুষ কণ্ঠের বিশ্রী সব খিস্তি এবং মারামারির আওয়াজ, সেইসাথে থাকে বাচ্চাদের আকুতি ভরা কান্না। একদিন মাঝরাতে ওই নারীর কান্নায় আমি ভীষণ বিরক্ত হয়েছি, সে দারোয়ানকে বলছে “প্লিজ দরজা খুলে দেন না, আমি বাইরে যাবো, না হলে আমার স্বামী আমাকে মেরেই ফেলবে’।
দারোয়ানরা দরজা খুলছিল না, কারণ ওই নারীর স্বামী উপর থেকে ফোন করে দারোয়ানদের বলেছে, “আমার বউ বাচ্চা যদি গেটের বাইরে যায়, তবে তোকে আমি পুলিশে দেব, তোকে পিটিয়ে মেরে ফেলবো” – মেয়েটি রোজ রোজ মার খায়, কিন্তু স্বামীর ভয়ে গেটের বাইরে যাবার সাহসটুকুও পায় না।
আমার এক বন্ধু আছে কলেজে পড়ায়, তাকে একদিন কফির আড্ডায় ডাকতেই সে বললো, “দেখি বরকে জিজ্ঞেস করে, সে যদি পারমিশন দেয় তো আসবো“। আমি একটু অবাক হলাম এবং মজা করে জিজ্ঞেস করলাম, “বর কোথাও গেলে তোর পারমিশন নেয় নাকি! বাব্বা কী প্রেম তোদের!” ও বললো, “না না সে কেন পারমিশন নেবে, স্বামীদের কি পারমিশনের প্রয়োজন আছে!”
সত্যিই তাই ! স্বামীদের কোনো পারমিশন নেবার প্রয়োজন নাই, কারণ জন্মগতভাবেই একজন পুরুষ জানেন, যে সে একজন জ্ঞান–বুদ্ধি সম্পন্ন সাবালক মানুষ। সে কোথায় যাবে, কী করবে সেটা সে তার বিচার বিবেচনা দিয়ে সে নিজেই ঠিক করবে। তাহলে স্ত্রীর কেন পারমিশন নেবার প্রয়োজন! তার কি জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচার–বিবেচনা কিছুই নাই!
এবার আসি আমার এই লেখার দ্বিতীয় প্যারায় যে নারীর কথা লিখেছি সেই প্রসঙ্গে, দৈনিক প্রথম আলোর একটি রিপোর্ট এসেছে যে বেশীরভাগ নারী নিজের ঘরেই নির্যাতিত। সেখানে বলা হয়েছে যে, ৬৫ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছেন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব নারীর ৭৭ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা বিগত এক বছরেও একই ধরনের নির্যাতন ভোগ করেছেন, সত্যি কি এটা বিস্ময়কর তথ্য! এই রিপোর্টে খুব একটা অবাক হবারও কিছু নাই বলে আমি মনে করি, কারণ এই রকম হাজার হাজার ঘটনা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে এবং সে সব গল্প আমাদের প্রায় সবারই জানা। কিন্তু কেন সর্বত্র এভাবে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সেটা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি!
নারীদের যুগে যুগে নির্যাতিত হবার একটাই কারণ, সেটা হলো আমাদের মানসিকতা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে একজন পুরুষকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়, নারী তার অধীনস্থ, নারীর উপর অতি সহজেই সে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে। আর অন্যদিকে নারীকে শেখানো হয়, স্বাধীনভাবে চলার কোনো অধিকার তার নাই, সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল, এই জন্য তাকে পুরুষের অধীনেই থাকতে হবে।
আমরা অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে আর্থ–সামাজিক কাঠামোর কারণে, সাংস্কৃতিক প্রভাবে এবং শিক্ষার অভাবে নারীরা দীর্ঘদিন পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে দুঃসহ জীবনযাপন করে এসেছে।
এখন কথা হচ্ছে যে, আমরা যারা নারী আমরা কি সত্যিই সজাগ আমাদের অধিকার সম্বন্ধে! প্রায় ১০০ বছরের বেশী সময় ধরে আমরা আমাদের সমঅধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি, কিন্তু এই অধিকার ব্যাপারটা আসলে কী? সেটা কি আমাদের কাছে পরিষ্কার? আর এই অধিকার আসলে আমরা কার কাছে চাই? কে দেবে আমাদের এই অধিকার?
পুরুষ যেমন মানুষ, তেমনি নারীও মানুষ। একজন মানুষ হিসাবে নারীরও নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী জীবন যাপন করা তার জন্মগত অধিকার। আপনাদের কি মনে হয় না যে আমরা এভাবে অধিকার চেয়ে চেয়ে নিজেদের দুর্বলভাবে উপস্থাপন করছি! আমি মনে করি যতদিন না আমরা আত্মনির্ভরশীল হবো, ততদিন নিজেদের সম্মান, অধিকার এবং মানুষ হিসাবে আমাদের স্বীকৃতি কিছুই আমরা পাবো না। আমরা পুরুষের উপর নির্ভর হতে পছন্দ করি, পুরুষদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে চাই এবং আমরা নিজেরাই আমাদের নিজেদেরকে দুর্বল ভাবি। আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুশাসন আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয় যে, একজন পুরুষ অভিভাবক ছাড়া আমরা জীবনে চলতেই পারবো না ।
নারীর জীবন পরিচালিত হয় সামাজিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে, কিন্তু এটা অনেকটা আমাদের নারীদের চিন্তা–চেতনার অজ্ঞতার জন্যই হয়েছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু এখন নারীদের শিক্ষার অবারিত সুযোগ, চাইলেই সে বুঝে নিতে পারে তাকে কী করতে হবে। কিন্তু এখনো যদি নারীরা জেগে ঘুমায়, তাহলে এই অধিকার আন্দোলন যুগ যুগ ধরে চললেও সেই অধিকার আদায় হবে না।
নারী অধিকার আদায়ের জন্য এই বিশেষ একটি দিন উৎসবের মত করে উদযাপনের প্রয়োজন আদৌ আছে বলে আমি মনে করি না। কে কাকে অধিকার দেয়? জন্মগতভাবে অধিকার সবারই থাকে, শুধু সেটা কার্যকর করার মত সাহস থাকতে হয়। আমরা যদি সত্যি চাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক, তা হলে আর দেরী না করে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেই না কেন যে আমার অধিকার কার্যকর করতে আমাকে কী করতে হবে বা আমার কী করা উচিত। একটু চিন্তা করে দেখলেই আমরা বুঝতে পারব যে অন্যের উপর এই নির্ভরশীলতা আমাদের মর্যাদা বাড়াচ্ছে নাকি ক্ষুণ্ণ করছে।
আসুন আমরা জেগে উঠি, অধিকার চেয়ে চেয়ে আন্দোলন না করে নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে শিখি। আমরা আত্মনির্ভরশীল হই, কারও দেওয়া স্বীকৃতি আশায় পিছিয়ে না থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাই পুরুষের পাশাপাশি। আমাদের অধিকার জন্মগত ভাবে আছেই, আমারা শুধু সেটা কার্যকর করব এবং সেই অধিকারে কেউ বাধা দিলে মোকাবেলা করার মত দৃঢ় মানসিক শক্তি সঞ্চার করবো এবং আর্থসামাজিক ভাবে নিজেকে স্বাবলম্বী করবো। শুধু ঘটা করে নারী দিবস পালন করা মানে হলো ঘটা করে নিজেদের দুর্বলতা আর আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করা ।

আপনার যারা নারী দিবসে নারীদের জন্য বিশেষ আয়োজন করে প্রমাণ করতে চান যে, নারীদের সমঅধিকার আদায়ে আপনারা নারীদের পাশেই আছেন, তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ যে, বছরে একবার নারীদের জন্য বিশেষ কোনো আয়োজন না করে, সারা বছর সচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রমের ব্যবস্থা করেন যেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়।
যদি নারীদের জন্য বিশেষ কিছু করতে চান তবে চেষ্টা করুন এমন কিছু করতে যেন এ দেশে যেন কোনো মেয়ে আর ধর্ষিতা না হয়, ঘরে ঘরে মেয়েরা নির্যাতিত না হয়, কোন শিশু যেন বিকৃত লালসার শিকার না হয়, যৌতুকের জন্য যেন কোন মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে না যায়, এসিড ছুড়ে কোন মেয়েকে যেন বীভৎস বানানো না হয়, বাল্য বিবাহের যাঁতাকলে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট না হয়, কর্মস্থলে এবং রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানীর শিকার হতে না হয়, কোন মেয়েকে যেন পতিতা পল্লীর অন্ধকারে পণ্য হতে না হয়। সত্যি যদি নারীদের পাশে দাঁড়াতে চান তবে মেয়েদের প্রতি সকল অবিচার বন্ধ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিন।
আসুন আমরা নতুন স্লোগানে সকল নারীকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি, “মেয়ে তুমি সাহসী হও, ঘুরে দাঁড়াও“।