ভদ্র-অভদ্র, মুখরা-বিনয়ী নির্ধারণের তুমি কে?

বিথী হক:

কালে কালে দেশে দেশে বিষবাষ্প ছড়ানোর জন্য অসুর, শয়তানরা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিল। প্রত্যেকটি আন্দোলন, ভালো কাজ সবকিছু ভণ্ডুল করে দিতে, আর আন্দোলনকারীদের ভেতরেই চাপা ঘেন্নার বীজ বুনে দিতে যুগে যুগে আবির্ভাব ঘটেছে লুটেরা ইংরেজ, পাকিস্তানি বেজাতি হানাদার আর জামাত-হেফাজতিদের।

যেকোনো আন্দোলন ভেস্তে দিতে সবচেয়ে কার্যকরি টোটকা হচ্ছে আন্দোলনকারীদের ভেতরেই বিভেদ সৃষ্টি করা। কে শুদ্ধ, কে অশুদ্ধ, কে ভালো, কে খারাপ, এমন নামমাত্র মানদণ্ডে বিকিয়ে যায় চৌকস, বুদ্ধিজীবী, বিপ্লবী যোদ্ধারা। খুঁজে বেড়াতে থাকে ‘আমার মতো শুদ্ধ আন্দোলন আর কে করছে’! খুঁজে বেড়াতে থাকে ‘খারাপ আন্দোলন যারা করছে তাদের বাদ দিয়ে দাও’।

বিথী হক

এই ভালো-খারাপ আর শুদ্ধ-অশুদ্ধ আন্দোলনকারীর সন্ধানে বেরিয়ে আন্দোলনকারীর কাছে দ্বিত হয়ে ওঠে মূল লক্ষ্য, কী ছিল, কেন যেন রাস্তায় নামা, সেটিও ক্রমশ ঝাপসা হয়ে ওঠে!

এই যে বিভেদ সৃষ্টিকারী মানুষগুলো, এরা কিন্তু সফল। তারা চানই আন্দোলন ভেস্তে যাক। কে কতখানি শুদ্ধ, সে বিচারের আগে আন্দোলনের আগুনে ছাই চাপা দিয়ে যারা আগুন নেভাতে চায়, দাবানলে বৃষ্টি নামিয়ে সব ভিজিয়ে দিতে চায়, তাদের খুঁজে বের করা উচিত। এরাই হাজার হাজার বছর ধরে ঠিক করে দিয়েছে কারা ভালো নারী, কারা খারাপ নারী! কাদের সতী বলা যায়, আর কাদের বেশ্যা! কাদের শরীর নরম হবে, আর কাদের শক্ত!

নারীবাদের যে আন্দোলন সেটা কি শুধু নরম আর শক্ত হবার আন্দোলন? সংসার ভাঙ্গা আর গড়ার আন্দোলন? লড়াইয়ের প্রাইমারি ভিতকে নড়িয়ে টারশিয়ারী দেয়াল নিয়ে লাফালাফি করলে অনেক নড়বড়ে আন্দোলনকারী যারা এখনো যোদ্ধা হয়ে ওঠেনি তারা যে ঝরে পড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে?

অনেকেই বলেন উগ্র নারীবাদী, অনেকেই বলেন কোমল নারীবাদী। আমি বলি নারীবাদ তো নারীবাদই, এর আবার উগ্র আর কোমল কী হে? কেউ যদি নরম ব্যক্তিত্বের হয়, নরম করে গান গায়, নরম পোশাক পরে আর নিজের অধিকার ঠিকঠাক করে বুঝে নেয়, তাকে কি নরম বা কোমল নারীবাদী বলা যায়? ব্যক্তিত্ব কোমল হবার সাথে বা উগ্র-চটপটে হবার সাথে উগ্র-কোমল নারীবাদের কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? কেউ চটপট করে কথা বলে, কেউ ধীরে-সুস্থে কথা বলে; এটি ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, আন্দোলনের নয়।

আমি স্বভাবগতভাবেই মুখরা। এই মুখরা অর্থ একেকজনের কাছে একেকরকম হতেই পারে। কেউ এমন কিছু বলছে যা আমার পছন্দ হচ্ছে না, বা এমন কিছু বলছে যা সত্য নয় বা অর্ধসত্য বা যা বলছে তা না জেনেই, এমন অবস্থায় সবাই ভদ্রস্থ হয়ে বসে থাকে, কারণ ওটাই ভদ্রতা হয়তো। এই কাজটি আমি পারি না। পারি না কারণ আমি মুখর, মানে মুখরা আর কী! এর মাঝ থেকে হয় আমি উঠে আসবো, বা থাকলে কথা বলে ফেলবো। এর বাইরে আর কোনো অপশন নেই।

এখন ধরুন আমি ভদ্রতা করে সব মেনে নিলাম, পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বিনয়ের সাথে কথা বললাম, তাহলেই কি আমি ‘আত্মমর্যাদাশীল’ নারী হয়ে উঠবো? আমার নারীবাদী আন্দোলন সার্থক হয়ে উঠবে? আর তেমন না হলে আমি আন্দোলন থেকে পিছিয়ে পড়বো? আমার অধিকার ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারবো না?

ভদ্র বা বিনয়ী বা মুখরা হবার সাথে সংঘবদ্ধ একটা আন্দোলন আসলে কতখানি সম্পৃক্ত? এই আন্দোলনটাই তো সমাজের হাতে চেপে বসা শক্ত লোহার হাতকড়া ভাঙ্গার লড়াই, প্রথার মাথায়, হাতে-পায়ে, গায়ে লাথি মেরে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এখন তাহলে কেউ এই প্রথা ভাঙ্গার আন্দোলনে আমার স্বভাব-চরিত্র কেমন হবে, কোন প্রথায় চললে লড়াই সহীহ-শুদ্ধ হবে সে শিক্ষা দেন, তাহলে মূল লড়াই প্রশ্নবিদ্ধ হবে কী না সেটি আমি জানতে চাই?

আমি জানতে চাই আমাকে কেন বিনয়ী, ভদ্রস্থ হয়ে থাকতে হবে? বা ‘হতে হবে’ এই নির্ধারণী কার ঠিক করা? সবাইকে সম্মান করে টইটম্বুর আত্মবিশ্বাসী হবার চেয়ে বরং নম্র-বিনয়ী হয়ে আন্দোলন করতে হবে, এই শিক্ষা কেন আমাকে কেউ দেবে? এবং যে বয়সে আত্মমর্যাদা কী সেটাই বোঝা শুরু করিনি, ভদ্র বা বিনয় কী জিনিস সেটিও মগজের সাথে লেপ্টে যায়নি, সে বয়সেই আমি ধর্ষিত হয়ে গেছি। আমার ধর্ষিত হবার ঘটনায় আমার আত্মমর্যাদার প্রশ্ন তোলা আসলে ধর্ষণের ঘটনার সাথে পোশাকের যোগসাজশ খোঁজার মতো গুরুতর অন্যায় এবং অপরাধ।

ধর্ষণকে যে কোনোভাবেই শর্ত দিয়ে যারা বৈধ করতে চান বা বৈধ না করে যুক্তি দিয়ে ধর্ষণের কারণ খণ্ডন করেন তারা আর যাই হোক নারীদের ধর্ষিত হবার কষ্টটা বুঝতে পারে না। পারে না বলেই ধর্ষণকে ধর্ষিতের ওড়নার সাথে বা আত্মমর্যাদার সাথে পেঁচিয়ে ফেলে।

দ্বিতীয় লিঙ্গকে কোনোভাবেই প্রথম লিঙ্গের সমান হতে দেওয়া যাবে না, বা হতে দিলেও সেটা শর্তসাপেক্ষে এমন মানসিকতার মানুষরা নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে যতই কথা বলুক, নারী আসলে প্রশ্নবিদ্ধ অস্তিত্ব সেটিই তাদের মূলভাব। কেউ মানেন বা না মানেন তাতে কিছুই এসে যায় না, ধর্মের সাথে নারীবাদের চাপা সংঘর্ষ আছেই। থাকবেই। আমি আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যখন লড়বো, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য পায়ে শক্তি এনে পায়ের তলায় মাটি শক্ত করার জন্য যুদ্ধ করবো, তখন যদি কেউ জামা টেনে ধরে ধর্মের দোহাই দিয়ে কোলে তুলে নেয় বা মাথায়ও তোলে, তখন তো আমার পক্ষে তার ধর্মের স্তুতি করা সম্ভব নয়।

আমি প্রথমেই একজন মানুষ, মানুষ হিসেবে আমার সকল অধিকার আমার চাই। সে অধিকার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যদি কারো ধর্ম আহত হয়, খুঁড়িয়ে চলে, তো সে দায় আমার নয়। আমি যা, তাই আমার ধর্ম। আমার ধর্ম তাই সমালোচনাযোগ্য। মুচলেকা দিয়ে কারো ধর্মে আঘাত না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে পারবো না, সেটা আমার লক্ষ্যও নয়।

সবার আগে আমি একজন মানুষ, তারপর নারী। আমি কারো মা, বোন, প্রেমিকা, স্ত্রী না হলে যদি কারো সম্মান করতে কষ্ট হয় তো হোক, সেটা তার সমস্যা। স্রেফ কারো সম্মান পাওয়ার জন্য কোনো সম্পর্কের বেড়াজালে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে কারো সম্মান পেতে চাই না। বা আমি যদি এই সম্পর্কগুলোর কোনোটিই না ধারণ করতে পারি, তাহলে কি আমি অসম্মানযোগ্য?

আমাকে সম্মান করতে হবে মানুষ হিসেবে। সম্মান করতে হবে আমার ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি, কাজ, মেধা আর এর কোনকিছুই না থাকলে শুধু আমার জন্মের অস্তিত্বকে। আমি একগামী না বহুগামী হবো, ভদ্র না অভদ্র হবো, কারো বউ হবো না রক্ষিতা(!) হবো, সেটা আমার পছন্দ। আমার ব্যক্তিগত পছন্দে নাক গলাবার সুযোগ কারো নেই, অন্য কারোরটায়ও যেমন আমার নেই।

পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ কম্প্রোমাইজ করা, যেটা করেই জন্ম থেকে নারীরা দ্বিতীয় লিঙ্গের পরিচয় নিয়ে দেদারসে শাড়ি-গয়না আর হাঁড়ি-পাতিলের জীবন-যাপন করছে। মেরুদণ্ডের যথাযথ ব্যবহার করে, নিজের পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে কম্প্রোমাইজের গলা টিপে নিজেরটা নিজে বুঝে নেওয়ার মাঝে যারা এতো বিভেদ তৈরি করে, আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তাদের কথা শুনে কষ্টিপাথর নিয়ে বসে নিজের নারীবাদ খাঁটি না খাদে ভরা সে যাচাই-বাছাই করাটা নির্বুদ্ধিতা।

আমি কেমন হবো, কী হবো, কীভাবে কথা বলবো, সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও এই আন্দোলনেরই অন্তর্গত। কারণ নারীবাদের এই আন্দোলন নারীদেরই ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় আন্দোলন। কারো কোনকিছু নির্ধারণ করে দেওয়ায় কিছুই সত্য-মিথ্যে হয়ে যায় না।

তাই এই প্রথাবান্ধব ভদ্র-বিনয়ী আগাছা পরগাছা কেটে কেটে নিজের হাঁটাপথ তৈরির কাজটা সবাইকেই যত্ন নিয়ে করতে হবে। আলগা আন্দোলনকারী আর আন্দোলনকারীর লেবাসে ঢুকে পড়া সমাজ-বন্ধুদের চিহ্নিত করে নিরাপদ দূরত্ব থেকে নিজের লড়াইটা চালিয়ে নিতে হবে, এরই মাঝে এবং এভাবেই।

দিনশেষে এই লড়াইটা আমাদেরই। নিজের লড়াই অন্য কারো নির্ধারণ করে দেওয়া শর্তে চালানোর মতো বোকামি দ্বিতীয়টি আর হয় না। দিনশেষে ভদ্র-অভদ্র, মুখরা-বিনয়ীর সংজ্ঞা যারা প্রণয়ন করে, প্রতিপক্ষ তারাই।

শেয়ার করুন: