শারমিন জান্নাত ভুট্টো: বছর বিশেক আগে যে কথাটি শুরু হয়েছিলো তা আজো আমার কানে বাজে। আমরা তিন বোন মোটামুটি কম-বেশি সবার কাছ থেকেই যে কথাটি শুনতাম, তা হলো-আমাদের গায়ের রং কালো। আর সে কারণেই পরিচিত-পরিজনদের গলা থেকে যে তাচ্ছিল্যের সুর ঝরতো, তাতে আমরা অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম দিনকে দিন। যদিও একটা ট্রমা কাজ করতো আমাদের মাঝে সব সময়। আর আমার ট্রমাটা খুবই হাস্যকর ছিলো। কোন গাঢ় রংয়ের পোশাক পরলে আমাকে আরও কালো লাগবে এটা মনে করে আমি কখনোই গাঢ় রংয়ের কোনো পোশাক পরিনি, শুধুমাত্র আমার পছন্দের রং নীল বাদে।
আমাদের জীবনের সে সময়টাতে শুধুই মনে হতো, সমাজে চামড়ার রংয়ের শক্তি সকল যোগ্যতা আর সামর্থ্যকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পারে অনায়াসে। আর এ গায়ের রং নিয়ে বংশ পরম্পরায় আমার মাকেও বহু তীর্যক কথা শুনতে হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে।
মোটামুটি অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, মেয়েদের গায়ের রংয়ের কারণে তাদের বিয়ে যাতে কোনমতে তাড়াতাড়ি দেয়া হয় এমন সুপারিশও আমাদের অভিভাবকের কাছে আসতে লাগলো আশপাশ থেকে। এমনকি আমার বাবা-মার চেয়ে অন্যান্য মানুষের কপালে বেশি ভাঁজ দেখা যেতো শুধুমাত্র আমাদের গায়ের রং কালো বলে। তার ওপর ফিনফিনে দেহ আর মাঝারি উচ্চতা কোনকিছুই যেনো ইতিবাচক কোন প্রভাব ফেলছিলো না আমাদের ওপর।
দিন যতোই যাচ্ছিল, সামগ্রিক পরিবেশ আমার বাবাকে কন্যা দায়গ্রস্থ পিতার খেতাব ঝুলিয়ে দেয়ার পাঁয়তারায় ছিলো। তবে আমার বাবা কিংবা মা কোনকিছুতেই কান দেয়নি। বরঞ্চ আমার মা তার সন্তানদের ঢাকা শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুল, কলেজে পড়িয়েছেন। দিনের পর দিন টেম্পুর পাদানিতে দাঁড়িয়ে নয়তো বা বাসের গরম ইঞ্জিনের পাশের সিটে বসে আমাদের ঠিক সময়েই পৌঁছে দিয়েছেন ক্লাসে। আর প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষায় কেন্দ্রের সামনে যিনি অপলক দৃষ্টিতে ঘর্মাক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তিনি ছিলেন আমার বাবা। “আমার একেকটা মেয়ে তোমাদের তিনটা ছেলের সমান, আমাকে আরও মেয়ে সন্তান দেয়া হোক” এ কথাগুলো যখন আমার বাবা অন্যদের মুখের উপর ছুঁড়ে দিতো, তখন আমাদের আত্মবিশ্বাসের পারদ, চূড়া ছুঁইছুঁই করতো।
বিজ্ঞান আর সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে সব সময় পড়ে এসেছি, কালো রংয়ের প্রখরতা বেশি। আর এ কারণেই হয়তো আমরা তিন বোন যেখানেই গিয়েছি, আমাদের মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে সেই প্রখরতাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। খেলাধূলা, থিয়েটার, গান, নাচ, তবলা আর কবিতা কোন কিছু শেখাতে পিছপা হননি আমাদের বাবা-মা। আমরা যে সমাজে বাস করতাম কিংবা এখনও করি, সেটির অন্যতম অন্ধকার দিক হচ্ছে ভীষণ রকমের বর্ণবাদিতা। সন্তান মেয়ে হলে কথা শোনাতে কার্পণ্য করে না কেউ, আর যদি রংটা ময়লা হয় তবে তো কথাই নেই, একটার পর একটা তীর বিঁধতে থাকে সে চামড়ায়।
কোন একবার রাস্তায় অবরোধের কারণে বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে প্রধান সড়কে অপেক্ষা করছিলেন আমার বাবা। স্বাভাবিকভাবেই পিতার মনে শংকা ও দু:শ্চিন্তা তার সন্তান শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে ঠিকমতো বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা! তখন আশেপাশের মানুষ আমার বাবাকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, তার মেয়েরা কালো, তাই রাস্তায় কেউ তাদের নিয়ে যাবে না। আজ যখন ইউরোপ, আমেরিকাতে বর্ণবাদ নিয়ে সবাই বেশ সোচ্চার, তখন আমি মনে মনে ভাবি, আমার দেশে বরঞ্চ এর প্রকটতা আরো বেশি এবং বহু আগে থেকেই এটি চর্চিত,চলিত।
আফসোস, আমাদের সমাজে শুধুমাত্র গায়ের রং নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনে যাচ্ছে, করা হচ্ছে অবহেলা দিনের পর দিন। আর কিছু লোক এর থেকে জোগাড় করছে তাদের মজার খোরাক।
তবে এটাও ঠিক এ কালো রং যতটাই আমাদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করেছে, ঠিক উল্টোটাই যেন হয়েছে আমাদের তিন বোনের সাথে। ডাক্তারি, শিক্ষকতা আর সাংবাদিকতা এই তিন পেশাকে আমরা যখন তিন বোন বেছে নিয়ে জীবন-সংগ্রামে রত, তখন অন্যরা তাদের চামড়ার রংয়ের বদৌলতে এখনও ঘরের চৌকাঠ পার হতে পারেনি। আমরা কৃতজ্ঞ আমাদের বাবা-মার প্রতি, যারা আমাদের বুঝিয়েছেন-শিখিয়েছেন কালো রংয়ের সৌন্দর্য, আর দেখিয়েছেন পৃথিবীর অন্য সব রং, তার রুপ এবং উজ্জ্বলতা। আর তাই তো আমরা রং নিয়ে নয়, বরং আমাদের সামর্থ্য, যোগ্যতা আর একাগ্রতা নিয়ে বড়াই করি।
যে সময়টাতে সবাই আমাদের রং ফর্সাকারি ক্রিম মাখার টিপস দিতো, সে সময়টাতে আমরা বোনরা মিলে ঘুরে বেরিয়েছি বইমেলা, কিনেছি বই, এমনকি সাত সকালে দুই বোন মিলে উপস্থিত হয়েছি বাংলাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ দেখতে আর আরেক বোন বিকেলে পাড়ি জমিয়েছে দিল্লীতে আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে অংশ নিতে। আমরা কালো ছিলাম বলেই সাহসিকতা আর উদ্দীপনা নিয়ে এখনও ছুটে বেড়িয়েছি নি:সংশয়ে, নি:সংকোচে। সমাজের কটু কথা আর ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে চলছি এখনও, চলবো আজীবন।