মলি জেনান: ‘Le souffle de Platon et le corps d’Aphrodit’- অর্থাৎ, ‘পরমাসুন্দরী আফ্রোদিতির দেহে প্লেটোর আত্মা যেন’! এই অসামান্য সুন্দর উক্তিটি যার জন্য প্রয়োগ করা হয়, তিনিই ‘হাইপেশিয়া’।
এই বিদুষী বিজ্ঞানী-গণিতজ্ঞ-দার্শনিক, স্বাধীনচেতা, অনিন্দ্যসুন্দর হাইপেশিয়ার জন্ম হয় ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্বান বাবা থিয়ন এর কাছে গণিত আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগৎ দেখার পাশাপাশি খুব ছোটবেলা থেকেই হাইপেশিয়া দেখেছিলো যুক্তির অপার সৌন্দর্য। আর সেই সৌন্দর্য প্রচারের জন্য আলেকজান্দ্রিয়ার মিউজিয়াম আর লাইব্রেরীকে বানিয়ে নিয়েছিলো নিজের পাঠশালা। তাঁর প্রজ্ঞার আলোয় আলোকিত হতে দুর-দূরান্ত থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার সেই পাঠশালায় ছুটে এসেছিলো জ্ঞানপিপাসুরা।
দিনে দিনে বাবার কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞানের গণ্ডি অতিক্রম করে হাইপেশিয়া বিচরণ করেন দর্শনের অবাক রাজ্যে। অচিরেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত আলেকজান্দ্রিয়ায়, আস্তে আস্তে সাধারণ জনতা এসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাইপেশিয়ার মুখ থেকে শুনতে থাকে সক্রেটিস, প্লেটো আর দর্শনের যতসব অমৃতবাক্য।
অন্যদিকে হাইপেশিয়া ছিলেন প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা, যা ছিল তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় গুরুদের চক্ষুশুল হবার প্রধান কারণ। হাইপেশিয়ার ব্যক্তিত্ব, বাগ্মিতা আর জ্ঞানের আলোক-স্পর্শে আলেকজান্দ্রিয়া এবং তার আশেপাশের লোকজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকে অনুসরণ করতো।
ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত হাইপেশিয়ার প্রেমে পড়েছিলো তার নিজের ছাত্রদের মধ্যকার অনেকেই, কিন্তু কঠিন ভাষায় তাদের কাছে অপারগতা আর অনীহা প্রকাশ করেন হাইপেশিয়া। যে সময়টাতে মেয়েদের দেখা হতো পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে, যখন মেয়েদের ঘর-গেরস্থালী আর সন্তান পালন ছাড়া কোন শিক্ষা ও কাজ ছিল না, সেই সময়ে তিনি তার অনুগতদের দৃঢ়তার সাথে বলতেন, ‘আমি সত্যের বাগদত্তা’।
খ্রিস্টিয় চার্চ তখন প্রাচীন প্যাগান মূল্যবোধ, প্রভাব আর সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলে তার শক্তিতে সংহত করার চেষ্টা করছে পুরোমাত্রায়। হাইপেশিয়া কট্টরপন্থী ধর্মান্ধতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন তার মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বিজ্ঞান, গণিত ও দর্শন নিয়ে। তার বিচক্ষণতা এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তখনকার নগরপাল অরিস্টিসও তার ছাত্র ও গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।
আমেরিকান বিজ্ঞানী J.W. Draper স্পষ্ট করেই বলেন,
-“হাইপেশিয়া ছিলেন ধর্মের বিপরীতে বিজ্ঞানের নিবিড় সমর্থক।”
তৎকালিন আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মগুরু পেট্রিয়াক সিরিল হাইপেশিয়ার রাজনৈতিক দর্শনের জন্য, তার মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও জনপ্রিয়তার জন্য তাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন এবং তাকে মনে করতেন খ্রিষ্টধর্মের বিকাশের অন্তরায়। মূলতঃ পেট্রিয়াক সিরিল খ্রিষ্ট ধর্মের পথ প্রশস্ত করার জন্যই হাইপেশিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। সিরিল হাইপেশিয়ার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে তাকে ধর্মদ্রোহী, চার্চবিদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে একদল উগ্র ধর্মান্ধ লেলিয়ে দেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে একদল ধর্মোন্মাদ খ্রিস্টান জনতার হাতে হাইপেশিয়া নিহত হন। বর্ণনামতে রথে করে ফেরার পথে উন্মত্ত জনতা তার উপর হামলা করে এবং তাকে টেনে-হিঁচড়ে নগ্ন করে ঝিনুক ও কাঁটা দিয়ে চামড়া তুলে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং দেহ ভষ্ম রাস্তায় ছড়িয়ে দেয়া হয়।
অনেক বিশেষজ্ঞই তাঁর মৃত্যুকে প্রাচীন আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এবং এই হেলেনীয় যুগের অবসানের ফলে পৃথিবীতে শুরু হয় এক চরম অন্ধকার যুগ, যা প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
ধর্মকে মুক্তবুদ্ধির চর্চার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টা এবং এই ধর্ম ব্যবসা সেই সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই চলে আসছে। আর এই নিকষ আধাঁর পথে যুগে যুগে আলো হাতে এসেছে হাইপেশিয়ারা…।
তথ্য সূত্রঃ-
১. নারী ও গণিত, শফিক ইসলাম।
২. মুক্তমনা বাংলা ব্লগ।
৩. সচলায়তন ব্লগ।
৪. উইকিপিডিয়া।