নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি মাত্র, উপেক্ষা করতে পারি না

দিনা ফেরদৌস: বলতে না পারা কথা অজানাই থেকে যায় আজীবন। সংসারে থেকে সাংসারিক জীবনের কথা বলতে  নিষেধ করেন অনেকেই। আর সহজ সমাধান দেন, না পোষালে ডিভোর্স।
 
ডিভোর্স দেয়ার মানসিক সাহস বেশিরভাগ নারীরই নেই। আবার বিচ্ছেদের পর নারীটি যখন নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করে, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে যতোজন না আসে, তার থেকে বেশি লোকজন প্রাক্তন স্বামীর নতুন সংসারের সুখের খবর নিয়ে আসে। শুধু ভাত-কাপড়ের চাহিদার জন্য তো আর সংসার নয়, তার চেয়েও বেশি কিছুর চাহিদা আছে বলেই নারী-পুরুষের এক সঙ্গে বসবাস। যৌন চাহিদা তার মধ্যে অন্যতম প্রাধান।
 
দিনা ফেরদৌস

এই সবের উপরেই ভিত্তি একটি ভারতীয় বাংলা মুভি দেখলাম সেদিন, “সাহেব বিবি গোলাম”। ছবিটি ২০১৬ তে মুক্তি পেয়েছে। গল্পের নায়িকা ‘জয়া’ (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) ঘোরতর সংসারী এক গৃহবধু। স্বামী, শাশুড়ি ও নয়/দশ বছরের একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। দেখতে বেশ সুন্দরী ও আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারী। এক সময় নাচ করতেন। মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার ফলে অন্যান্য মা-অভিভাবকদের সাথে জয়ার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে।

একদিন মেয়ের স্কুল টিচার খাতায় মেয়ের ভুল দেখানোর নাম করে জয়ার হাত বোলাতে থাকেন। বান্ধবীকে ঘটনাটি বললে সে প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করতে বলে। জয়া অমত করে। বহুদিন পর পুরুষের স্পর্শ তাকে আন্দোলিত করেছে জানায়। কারণ জানতে চাইলে সে বলে, স্বামীর সুখ থেকে সে বঞ্চিত। স্বামীর কাছ থেকে তীব্র প্রত্যাখ্যান দিন দিন তাকে নিজের প্রতি অবহেলায়, অপমানে ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে অসহায় করে ফেলেছে। তার পক্ষে সংসার, সন্তান কোনোটাই ছাড়া সম্ভব না। সব শুনে বান্ধবী তাকে এক জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে সংসার ছাড়তে না পারা ও স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সুখ থেকে বঞ্চিতরাই যায়।

স্বামীর সাথে ঝগড়া-ঝাঁটি,মারামারির সম্পর্ক হলে আমরা খবর পাই। আবার বিকৃতভাবে যদি কোনো স্বামী যৌন সুখ পেতে চায়, তো তাকেও আমরা নির্যাতন বলি। কিন্তু নীরবে একই ঘরে, একই বিছানায় থেকে স্ত্রীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যখন কোনো স্বামী মাসের পর মাস কিংবা বছর গড়িয়ে যায় যৌন সম্পর্কহীন, তখন সেটাকে নির্যাতন বলি না, এমনকি সেই খবরও পাই না। কেউ এই বিষয়ে মুখ খুলে না বলেই আমরা হঠাৎ কারো কাছে এইসব কথা শুনলে সাধারণ বিষয় বলে উড়িয়ে দেই।

মেয়েরা নিজের সমবয়সী কাউকে বলতে গেলে শুনতে হয় টুকিটাকি বিষয় মিটায়ে ফেল। কেমনে মিটাতে হয় তার সমাধান তার জানা নেই, কারণ তিনি তো কম করে হলেও সপ্তাহে অন্তত দু’দিন স্বামীর সাথে সহবাস করেন।

পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীর সাথে শেয়ার করতে যান, সমাধান দিবেন, কই আমার তো ইচ্ছেই হয় না। ইচ্ছে হলেই যিনি পাচ্ছেন, আর যার ইচ্ছেই হয় না; দুটোই মূলত তাদের ইচ্ছেতেই হচ্ছে। কিন্তু যিনি চেয়েও পাচ্ছেন না, সেটা মেনে নিয়ে সাংসারিক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে, সমাজে প্রতিদিন হাসিমুখে নিজেকে প্রেজেন্ট করা কী কঠিন, তা ভুক্তভোগীই ভালো জানেন।
 
পরিচিত একজনকে নিয়ে আমার সিনিয়র মহলে বেশ কিছুদিন কথা শুনে আসছিলাম যে, তার চরিত্রে সমস্যা আছে, তার নাকি খাই খাই স্বভাব। পুরুষের চরিত্র ঠিক রাখার জন্য ব্রোথেল হোম আছে। তাই বাইরে সব সেরে এসে ঘরে সাধু পুরুষ হয়ে থাকতে পারেন। মেয়েদের যেহেতু সেই সুযোগ নেই, তাই কারও খাই খাই আছে জানলে বাকিরা তাকে গিলেই খেয়ে ফেলেন।
যার কথা বলছিলাম তিনি বিবাহিত, কোনো বাচ্চা-কাচ্চা নেই। বিয়ের প্রথমদিকে সব স্বাভাবিক থাকলেও বছর খানেক পরে স্বামী পাল্টাতে থাকেন। ঘরে ফিরেই হয় কম্পিউটার খুলে বসেন, নয়, কোনো অসুস্থতার বাহানায় এড়িয়ে যান। অনেকেই মনে করেন, বাচ্চা না হওয়াতেই বৌয়ের প্রতি এই অবহেলা।
আরেকজন নিজে আমাকে বলেছেন, তার একটা বাচ্চাও আছে, কিন্তু তিনি কোনোদিন সঙ্গমে সুখ কী তা জানেন না।তার স্বামীও সেটা বুঝতে পারেন। তাই সারাক্ষণ বৌয়ের ভুল খুঁজে বের করতে ব্যস্ত থাকেন। ছোটখাটো বিষয়কে স্বামী বড় বানিয়ে সব সময় একটা বিশ্রী পরিবেশ তৈরি করেন। বাচ্চা জন্মদানের সঙ্গে যৌন সুখের কোনো সম্পর্ক নাই এটা বেশিরভাগই বুঝতে অপারগ।

কথা হচ্ছে ,স্বামী শুধু মারপিট করলেই আমরা তাকে নির্যাতন বলে জানি, কিন্তু যৌন সুখ থেকে বঞ্চিত করেও যে স্ত্রীকে এক কঠিন ধরনের নীরব মানসিক নির্যাতন করা হয়, তা ব্যক্তি না বললে আজীবন অজানাই থেকে যায়। তার প্রভাব নারীদের কাজে-কর্মে সব ক্ষেত্রেই পড়ে। অথচ যৌন চাহিদা আমাদের ঘুম, খাওয়া, টয়লেট করার মতোই প্রয়োজনীয়। শরীর থাকলে চাহিদা থাকবেই। আমরা নিয়ন্ত্রণ করি মাত্র, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারি না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.