এই আইন কার স্বার্থে?

রীতা নাহার

নীলফামারীর জলঢাকার শিমুলবাড়ি গ্রামের সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় শিরিনকে তার মতের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেয় পরিবার। সেই বিয়ে ভেঙ্গে আবারও স্কুলে ফিরেছে শিরিন। পড়ছে নবম শ্রেণীতে। স্বপ্ন দেখে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। বিন্নাকুড়ি গ্রামের আরজিনা এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় পরিবার যখন বিয়ের উদ্যোগ নেয়, বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে পরিবারকে বুঝিয়ে ওই বিয়ে আটকে দেয় আরজিনা।

শিরিন আর আরজিনার মতো অনেকেই নিজেদের অকাল বিয়ে ভেঙে দিয়ে আবারও ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনে, পড়াশোনায়। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে একদল শিশুকিশোর তাদের এলাকায় এনেছে এক সামাজিক বিপ্লব। ২০১৩ সালে বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে গেলে এমনি অভূতপূর্ব সব অভিজ্ঞতা হয়। ওই রিপোর্টের জন্য চষে বেরিয়েছি পুরো নীলফামারী।

রীতা নাহার, সাংবাদিক

২০০৮ এ দেশের ২২টি ইউনিয়নকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা। আর তাই নীলফামারী জেলাকে ঘিরে বাল্যবিয়ে বন্ধের সূত্র খুঁজে ফেরা।

সারাদেশে বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি নিয়ে হতাশার নানা চিত্রের মধ্যেও বাল্যবিয়ে রোধে মাঠ পর্যায়ে বেশ কিছু বড় সাফল্য এসেছে দেশের উত্তরের জেলা নীলফামারীতে। জলঢাকার কৈমারী ইউনিয়নের কিশোর কেশব নিজের উদ্যোগে ২৬টি শিশু বিয়ে বন্ধ করে সেখানকার কিশোর সংগঠক কেশব পায় জাতিসংঘের স্বীকৃতি। যা গোটা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান কেশবকে এখনও এক বেলা খাবার যোগাড় করতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথায় নিয়ে চলে প্রতিদিনের জীবন সংগ্রাম। কিন্তু অদম্য এ কিশোর বাল্যবিবাহ রোধের মতো কঠিন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিজের সব সংকট পায়ে দলে। এভাবেই কেশব ও তার সহপাঠীরা জলঢাকা উপজেলার কৈমারি, শৌলমারি, গোলমুন্ডা, গোলনা, ডাওয়াবাড়ি, বালাগ্রাম, খুটামারা, শিমুলবাড়ি, মীরগঞ্জ, ধর্মপাল, কাঁঠালি- এই ১১টি ইউনিয়ন ও জলঢাকা পৌরসভা শিশুবিয়ে মুক্ত করে। ওইসব এলাকাবাসী অহংকার করে বলে তাদের এলাকায় বাল্যবিয়ে নেই। শিশুদের তৎপরতার কারণে বাল্যবিয়ের পক্ষে কোন অভিভাবক কথা বলতেও লজ্জিত হন!

অথচ কী গভীর লজ্জার বিষয় রাষ্ট্রই এখন ওইসব অভিভাবককে সুযোগ তৈরি করে দিলো যারা নানা অজুহাতে শিক্ষার আলো ও আর সুন্দর শৈশব বঞ্চিত করে কোমলমতি শিশুদের চাপিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের ইচ্ছের নামে সংসারের বোঝা। সদ্য পাশ হওয়া বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধানটিই এখনই বাল্য বিয়ে রোধের বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল।

এই বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাই কিছু থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পন্ন হইলে তা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’ বিশেষ ক্ষেত্রে বলতে সংসদে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, যেখানে ধর্ষণের শিকার হয়ে কিংবা প্রেমের কারণে কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে সেক্ষেত্রে বিশেষ বিধানে বিয়ের মাধ্যমে তার সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করা যাবে।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষকের যথাযথ বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো সন্তানের জন্ম হলে ওই ধর্ষক নয়, রাষ্ট্রীয় পরিচয়েই তার বড় হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রকেই তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং শিক্ষার অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে। ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে কোনো সভ্য সমাজেই গ্রহণযোগ্য হতে পাারে না। কিন্তু বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের বিশেষ বিধান ধর্ষককে পার পেয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দিল।

সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, প্রত্যন্ত গ্রামে সমাজের বাস্তবতা বুঝতে হবে। তাহলে কি প্রত্যন্ত গ্রামের বিপদজনক বাস্তবতা হচ্ছে ধর্ষণ?  সেখানে কি নারী শিশুরা প্রেমের প্রলোভনে পড়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়াটাই বিশেষ বাস্তবতা?

না, আমার পেশাগত সরেজমিন অভিজ্ঞতা তা বলে না। বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও তথাকথিত ধর্মগুরুদের নানা রকম ফতোয়া, গ্রাম্য মাতবরদের সালিশ, কম বয়সে বিয়ে হলে যৌতুক কম, পরিবারের  পুরুষ প্রধানের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নারীর দুর্বিষহ জীবনের বাস্তবতাই সবচেয়ে নিদারুণ।

অনেক ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বৃষ্টি’ গল্পের উদাহরণ টেনে বলবো, সত্তরের দশকে লেখা সেই গল্পে অন্তঃসত্ত্বা একজন বিধবার বিচার নিয়ে ভয়াবহ প্রহসন হয়েছিল, সেই প্রহসন এখনও সমাজে বিদ্যমান। সমাজে অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী শিশুরা স্বেচ্ছায় প্রেমে পড়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনা খুবই কম। বরং রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয়ে ক্ষমতার দাপট দেখানো পাড়ার রংবাজ কিংবা বখাটের ইভ টিজিং, হামলা ধর্ষণের ঘটনাই সবচেয়ে বেশী। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই বখাটেদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র, সমাজ দু’টোই ব্যর্থ। স্থানীয় প্রশাসন থেকে জনপ্রতিনিধি সবাই বখাটের পক্ষে। যেখানে তাদের হামলার শিকার নারীরা সারা দেশে শুধু গ্রামে নয়, এই শহর কিংবা শহরতলিতেও অসহায়।

নতুন বাল্য বিয়ে নিরোধ আইন সেই অসহায় নারীর পক্ষে নয়, বরং সেই সব রংবাজ বখাটেদের বিচার কিংবা শাস্তির হাত থেকে রক্ষাকবচ হয়ে গেল। দুর্ভাগ্য হচ্ছে সরকারের নীতি নির্ধারকরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাস্তবতাকে বখাটে লালনকারী স্থানীয় ধর্মগুরু, রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের চোখ দিয়েই দেখেছেন, সত্যিটা দেখেননি। নয়তো একশ’ বছর আগে বাল্য বিয়ে বন্ধে যে আইন করা হয়েছিল উপমহাদেশে, তাতে ১৮ এর নীচে বিয়ে- বাল্যবিয়ে বলে গণ্য ও নিষিদ্ধ ছিল। সংবিধান অনুযায়ীও ১৮ এর নীচে বয়সীরা শিশু। অর্থাৎ নতুন বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন শতবর্ষী আইনের চেয়েও প্রাচীন ধারণার হয়ে রইলো। নারী স্বাধীনতা আর নারীর ক্ষমতায়নের পথে আমরা পিছিয়ে গেলাম ১শ’ বছর।  বাড়বে শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঝরে পড়া ছাত্রীর সংখ্যা। নারী-পুরুষ সমান তালে এগিয়ে চলতে না পারলে এসডিজি গোলের মতো বড় বড় অনেক জাতীয় ও বৈশ্বিক লক্ষ্যই রয়ে যাবে অপূরণীয়।       

শেষে আবার ফিরবো নীলফামারীতেই। জলঢাকার বিন্নাকুড়ি গ্রামের মেয়ে সোহাগী, সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। আমরা যখন রিপোর্টের কাজে সোহাগীর গ্রামে যাই। দেখি বাড়ির সামনে একদল শিশু। জানতে পারি, সোহাগীর পরিবার বিয়ে ঠিক করেছে আর শিশুদল এসেছে বিয়ে ঠেকাতে। এক পর্যায়ে বাড়ির মুরুব্বিরা সম্মত হন বিয়ে বন্ধে। সেদিনের মতো আর কোন সোহাগীর বিয়ে বন্ধ করে ক্লাস ফিরিয়ে আনতে পারবে কি ওদের সহপাঠীরা! নতুন আত্মঘাতী এই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়নের পর সোহাগীদের জন্য আর কোনো পথ কি খোলা রইলো?

রীতা নাহার, সাংবাদিক

২৮.০২.২০১৭

ঢাকা

শেয়ার করুন: