কাটছাঁটের দায় নেয়া সকল নারীদের বলছি

জিনিয়া চৌধুরী: মাসটার নাম জানুয়ারি, বছরের শুরু।
বাড়িওয়ালার চোখে নুতন স্বপ্ন। সামনের মাস থেকেই প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে, ছোট বড় মিলিয়ে ১৭ খানা ফ্ল্যাট। গড়ে হাজার দুয়েক করে বাড়ালে এক লাফে আয় বেড়ে যাবে ৩৪০০০ টাকা। ভাগ্যিস ঢাকা শহরের বুকে একখণ্ড জায়গা ছিলো তার। পরম নিশ্চিন্তের আয়, কেবল সুযোগ বুঝে ভাড়ার হিসেবটা কষে দিলেই হলো। বছরের শুরু তো আছেই, মাঝের দিকেও ভাড়াটিয়া পাল্টালেই ভাড়া বাড়ানোর মোক্ষম সুযোগটাও রয়েছে।
সামনের মাস থেকে বাড়তি ভাড়ায়, ছেলের জন্য কেনা নুতন গাড়ির কিস্তিটা নিশ্চিত। সেটা শেষ হয়ে গেলেই নুতন কেনা জায়গাটায় আবারও বাড়ির কাজ শুরু করবেন তিনি। ইটের উপর ইট গাঁথার শিল্পটা তিনি শিখে গেছেন, এই গাঁথুনির আরেক নাম টাকা।
 
জিনিয়া চৌধুরী

সরকারি চাকুরে,

দিনশেষে তোলেন তৃপ্তির ঢেঁকুর। বেতনটা লাফিয়ে লাফিয়ে ছুঁয়েছে আকাশের রোদ। নিজের নামে রয়েছে সরকারি কোয়ার্টার। নর্মাল বাসা তাই ভাড়া দিয়ে রাখা। অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটের চাকচিক্যটা ভীষণ দরকার। ছেলেমেয়ের স্ট্যাটাস বলে কথা। নিজে না হয়  কলম পেশা কেরানী, তাতে কী? দুটো বাচ্চাই কেতাদুরস্ত সাহেব হওয়ার চর্চায় ব্যস্ত। এই কিছুদিন আগেও কেবল উপরি আয় দিয়ে সারতে হয়েছে সবটা, তাই খুব এগুতে পারেননি। এখন বেতনটা ভাবনার সীমা ছাড়ানোতে, সুন্দরভাবে মেটানো যাচ্ছে সমস্ত দায়, ফলে উপরি ইনকাম দিয়ে খুব দ্রুতই নামে-বেনামে কেনা যাচ্ছে বেশ কিছু প্লট, জমি।সামনের দিনগুলো বেশ অত্যুজ্বল,ভবিষ্যতটা যেন চকচকে হয়ে দেখা দেয় চোখের তারায়।
বেসরকারি চাকরিজীবী,
আয়ের স্কেলটা নিম্ন মধ্যবিত্তের তালিকায়। মাসটা ফেব্রুয়ারি। বছরের শুরুতেই ধাক্কা, বছরের শেষের কানাঘুষোটাই বাস্তব হয়ে যায়। কোম্পানি লাভের মুখ দেখলেও কোন অযুহাত ছাড়াই এ বছর বেতন না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তাদের। কিছুই করার নাই। কর্তার ইচ্ছাই এখানে কর্ম। নিয়ম মতোই বেড়েছে বাড়িভাড়া, বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের বেতন, গাড়িভাড়া আর বাজার খরচের হিসেবটা। ক্রমাগতই ছোট হচ্ছে ন্যুনতম শখের তালিকাটি।
দুটাকা চার টাকার হিসেব মিলিয়ে জোড়াতালি দেবার প্রয়াসে ব্যস্ত নাগরিক জীবনটায় মরার ওপর খাড়ার ঘা এর মতো- সামনের মাস থেকে বাড়ছে গ্যাসের দাম। গ্যাসের বাড়তি মূল্য যে কেবল গ্যাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা না। এর প্রভাব পড়বে দৈনন্দিন প্রতিটি ব্যবহারিক জিনিষের ওপরও। 
সকালেই বাড়িওয়ালার গুরুগম্ভীর গলা, গ্যাসের দাম বেড়েছে, বাড়বে অন্যান্য সব। আয়টাও তার বাড়া দরকার, বছরের মাঝামাঝি তিনি  আরও শ’পাঁচেক টাকা ভাড়া বাড়ানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন। উদাহরণ দেন অন্যান্য সরকারি কর্মচারি ভাড়াটিয়ার।
নিম্নমধ্যবিত্ত গৃহিনী,
যিনি সকাল থেকে রাত, আয়ের প্রতিটি কণা ব্যয় করেন হিসেবের নিক্তিতে, তিনি আবার নুতন করে হিসেব কষতে থাকেন।কাটছাঁট করতে বসেন ব্যক্তিগত ন্যুনতম চাহিদাগুলোর। সকালের চা হাতে খবরের কাগজ পড়াটা, নাহ ওটা বিলাসিতা, দু বেলার চা খাওয়াটা? সেটাও দিব্যি একবেলা করে নেয়া যায়। হাঁটুর ব্যথার কারণে মাঝে মাঝে রিক্সায় ওঠা। ওটাও মনে হয় শখের তালিকার।
বাচ্চার দুধে দু-চামচ হরলিক্স, না হয় দেড় করে দেবো, সাহেবের বিলাসিতা এক বেলা কফি খাওয়া, ওটাও কী? নাহ, বেচারার ওটুকুই তো আয়েস। বাচ্চার টিফিনে দুটো রুটি জুড়ে দিয়ে কর্নফ্লেক্সটা কমাবো? মায়ের মন, মানবে কেন? অবশেষে ঠিক হয়, অনেক হলো, এবার থেকে ডাক্তারের দেয়া নিয়মিত ওষুধগুলো তার বাদ দিতে হবে, শরীরে খুব ব্যথা হলে, না হয় একটা পেইন কিলার। ছোটা গৃহকর্মীকে বলতে হবে মুটিয়ে যাচ্ছি, সামনের মাস থেকে ঘরটা আমিই মুছবো, ব্যায়াম হবে খানিক।
সপ্তাহে এক দুখানা ডিম না খেলে খুব বেশী কী আর সমস্যা! মাঝে মাঝে বাচ্চাকাচ্চা পড়তে বসলে দুজনে মিলে সন্ধ্যায় একটু ঘুরতে বের হওয়া, আপাতত তোলা থাক। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে, সকালে বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ বাজারে বের হওয়ার আগে, একটু প্রসাধনীর ব্যবহার- সস্তায় কিছু একটু হলে হবে, না হলেও মানিয়ে যাবে, দরকার হলে মুখটাও ঢেকে নেয়া যাবে হিজাবের আড়ালেই।
তাই রাষ্ট্রের এই বাড়তি চাপ মেনে নিয়ে এডজাস্ট হয়ে যাওয়াটাকেই নিয়তি বলে ধরে নিয়েছেন আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত নারীরা।
অথচ কাটছাঁটের এই ঘেরাটোপের নিষ্পেষণে মুখ বুঁজে কেন থাকছেন, ভেবে দেখবেন কি? চাপিয়ে দেয়া এই বাড়তি অর্থনৈতিক, অযৌক্তিক প্রেশার কেন মেনে নেবেন? বরং এর বিরুদ্ধে যৌক্তিক অবস্থান গ্রহন করুন। সকল সংসার সামলানো নারীদের আহ্বান জানাচ্ছি, রাজপথে দাঁড়িয়ে তারা সরকারকে বুঝিয়ে দিক একটা পরিবারের দুটো চুলার উপরে কীভাবে নির্ভর করে পরিবারটির সার্বিক সাচ্ছন্দ্য!  
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.