সাবিরা শাওন: আমি বুঝি না মানুষ আর মেয়েমানুষ এই শব্দ দুটোর মাঝে এতো পার্থক্য কেন? মানুষ কথাটি যেখানে সম্মানের আধার আর মেয়েমানুষ মানেই কিছুটা অন্যরকম, অথবা ভোগের সামগ্রী। আর একটু সম্মানের জন্য কিংবা নিজের অধিকারবোধ নিয়ে যদি কথা বলে তবেই চারদিকে গেল গেল রব উঠে। তখনই সে হয় ব্যাটাছেলে, অ্যাগ্রেসিভ। এমনকি বড় হয়ে কোনো মেয়ে যদি প্রতিবাদের ভাষায় কথা বলে, তখন পরিবারের অনেকেই বলে, “তোর কথায় পুরুষালি গন্ধ আসছে”।

যখন যা কিছু অঘটন ঘটে তার জন্য কে দায়ী? আমি? কেন? আমি মেয়েমানুষ। কিছুদিন আগে আমি যে স্কুলটাতে চাকরি করতাম, সেই স্কুলটার প্রতিষ্ঠাতা আর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল স্যার দুজনই ছিলেন ধর্ম প্রিয় মানুষ। আমি সেখানে ৯ম-১০ম শ্রেণীতে জীববিজ্ঞান পড়াতাম। একদিন ক্লাসে যাওয়ার সময় প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে ডেকে আমাকে বলছেন, ‘ম্যাডাম, আপনি এখন যে বিষয়টা (জীব প্রজনন ও বংশগতি) পড়াচ্ছেন, তাতে আপত্তিকর পড়াগুলো এড়িয়ে যাবেন। ছেলেমেয়ের একসাথে ক্লাস, তা পড়ালে সমস্যা হবে, পরিবেশ নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকবে’।
আমি এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেও পরবর্তীতে সোজা হয়ে বসে তাকে ধৈর্য ধরে বুঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি মাদ্রাসা থেকে পাশ করেছেন বলে শুধু বার বার আগুন আর মোম তত্ত্ব দিয়ে আমাকে থামতে বাধ্য করেছিলেন। সেদিন এসেই রিজাইন লেটারটা মনে মনে লিখে ফেলি।
তাই বলে আমি কিন্তু থেমে যাইনি, ঠিকই জীবের প্রজনন আর বংশগতি পড়িয়েছিলাম। পরবর্তী মিটিংয়ে যখন ছাত্রী এবং শিক্ষকদের বোরকা অথবা হিজাব বাধ্যতামূলক করে, তার পরদিনই চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ স্বভাবসুলভ ঘাড়ত্যাড়া হওয়ায় আমি আমার শান্তি আর স্বস্তিকে বজায় রাখতে বোরকা আর হিজাব গ্রহণ করিনি।
আমি মেয়ে তাই আমার জোরে হাসা যাবে না, বন্ধুদের সাথে টং দোকানে বসে চা খাওয়া যাবে না। কেন? কারণ ওটা ছেলেদের জন্মগত অধিকার, আমাদের না। কিন্তু আমার যতদূর মনে হয় কোন চায়ের কাপে কিংবা রাস্তার মোড়ে লেখা দেখিনি No Ladies zone. তবু আমরা সেই সীমানায় যেতে ভয় পাই। সমাজের কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষ যে অদৃশ্য দেয়ালটা তুলে দিয়েছে আমরা আজও তার আড়ালে হাঁসফাঁস করি।
মেয়েরা বাইরে যাবে তার নিরাপত্তার ভাবনায় ঘরের মানুষের ঘুম হারাম। মেয়েদের নিরাপত্তার প্রসঙ্গটা আমার কাছে ক্ষেত্রবিশেষে নির্মল কৌতুক। যে মেয়েটি নিজের অধিকারগুলো সম্পর্কে জানে না, প্রতিটি পদক্ষেপে নিগৃহীত হয় তার আবার নিরাপত্তা! একটা জাতির মানুষের নিরাপত্তা বিধান করে রাষ্ট্রযন্ত্র। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস আমার নাই, তবে চারপাশের ঘটনার প্রেক্ষিতে সত্য বলার সাহস আছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কখনো কখনো সাধারণ মানুষের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার নমুনা চিত্র প্রতিনিয়ত খবরের কাগজ পড়লেই জানা যায়।
অনেকেই বলবেন মেয়েরা তো এখন সব ক্ষেত্রে কাজ করছে ,অবদান রাখছে সমাজের সব ক্ষেত্রে। হ্যাঁ আমরা কাজ করছি কিন্তু তা এখনো পুরোপুরি আমাদের মানসিক স্বাধীনতা নিয়ে নয়। আমি নারীবাদ নিয়ে লিখতে বসি নাই, তবু বলছি আজকে নারীরা যে পজিশনে আছে, তা শুধু পুরুষ চেয়েছে বলে আর অল্প কিছু মেয়ের মানসিক ও বুদ্ধির জোরে। পুরুষরা আমাদের অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকেই হয়তো সহমত দিবেন, আবার অনেকেই অবাক হবেন। আমি আমার ভাবনাটা খোলসা করে বলছি।
ভেবে দেখুন সেই গোঁড়ার সময়ের কথা, যখন পুরুষ পড়াশোনা করতো মিল্টন, শেক্সসপিয়র, শেলীর কবিতা। তখন লেখার বর্ণনায় নিজের বালিকাবধূর কথা ভেবে তাকে কাব্যরস বুঝাতো। কিন্তু লাভ হয়নি, কারণ যার গণ্ডি বাড়ির চাকর ননী দত্ত কিংবা জগাই পর্যন্ত, তার খুপরিতে মিল্টন ঢুকানো অসাধ্য। কতিপয় পুরুষ তখন নিজের প্রেমের তোড়ে অথবা নারীর জাগরণের কথা ভেবেই গৃহদেবীদের একটু একটু করে পড়তে শিখিয়েছে। নারীদের বাইরে কাজ করতে দেওয়া এটাও নিজেদের প্রয়োজনের সভ্যতার নতুন রুপ।
খুব অল্পসংখ্যক মেয়ে আছে যে তার উপার্জনকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারে। আর বাকিদের সংসারের জোয়ালে সমানভাবে কাঁধ দিতে হয়। এই হলো আমাদের স্বাধীনতা। দুর্যোধন যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল তখন তাকে ধিক্কার দেই, আবার প্রেমিক বেশে রাম যখন সীতার সতীত্বের পরীক্ষা নেয়, তখন তাকে সাধুবাদ দেই। বাহ! কী আমাদের বিচারবুদ্ধি।
আমি একপেশে বলছি না, আমাদেরও দোষ আছে, কারণ নৈতিক অবক্ষয়ের গ্রাস থেকে আমরা কেউ মুক্তি পাইনি। কারণ আমরাই তো পুরুষের বিকৃত মানসিকতাকে আশকারা দেই। আপনি এমন বিকৃত মস্তিষ্কের নাই হতে পারেন, কিন্তু আমার প্রেমিক, স্বামী হয়তোবা এমন। নারী জাগরণ বলতে যা বুঝায়, তা এখনো সব নারীকে জাগাতে পারেনি। নারীর জাগরণ, স্বাধীনতা আর মানসিক দাসত্ব প্রায় একই রুপের হয়। এখনো অনেকেই আমরা এর রঙ চিনতে ভুল করি।
স্বাধীনতা হলো মনের মুক্তি। মেয়েমানুষ না, মানুষ হিসেবে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচা, পুরোটা চোখ মেলে আকাশ দেখা।