রক্তে ভেজা মুক্তি নিশান, নারী স্বাস্থ্য ও পুং-ট্যাবুর বিরোধ

ছন্দক চ্যাটার্জি:

মেয়েলির গ্রামাঞ্চল দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক শহরকে ঘিরে ফেলা একান্ত দরকার। কারণ নারীর না হয়ে রজঃস্রাব যদি পুরুষের হতো, তাহলে হয়তোবা ওই রক্তকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হতো। কিন্তু এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর রক্তকে ঘৃণা করেছে। তাই নারীরাই তাদের পবিত্র রক্ত দিয়ে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে লিখে রাখুক গর্জে ওঠার কাহিনী। রাঙিয়ে নিক তাদের রক্তে ভেজা লাল নিশান। মেয়েদের মানসিক মুক্তাঞ্চলে উড়ুক ঋতুমতীর চিহ্ন বাহক পতাকা।

আমরা গ্রামের মেয়ে হয়েও অনুপ্রাণিত চিলির সেই শিল্পীর থেকে যিনি পাঁচ বছর ধরে জমানো মাসিকের রক্তের প্রদর্শনী করেছিলেন। আমরা সমর্থন করি সেই ‘বেলেল্লে’ ধিঙ্গি মেয়েদের যারা মেয়েদের শৌচাগারে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া গিয়েছিলো বলে প্রথমে কারখানায় নগ্ন তল্লাশির শিকার হন, কিন্তু পরদিনই সেই স্যানিটারি ন্যাপকিনে প্রতিবাদ লিখে সংস্থার ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিলেন। আমরা প্রতিরোধে সামিল পুংকেন্দ্রিক সংস্কৃতির। যে নান্দনিকতা সৌরভ গাঙ্গুলীর জামা খুলে ওড়ানোকে সেলিব্রেট করে আর ‘ফেমেন’র মেয়েদের খোলা বুকে পিঠে শ্লোগান লেখাকে কারারুদ্ধ করে।

যে নরনারী পাঁচমাথার মোড়ে খোলা স্যানিটারি ন্যাপকিন হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরে না তাকে আমরা ঘৃণা করি। যে বোকাবাক্সে নীল রক্তের পণ্যায়িত বিজ্ঞাপন দেখে নাক সিটকায় না তাকে আমরা ঘৃণা করি। যে পিতা মেয়ের বিয়ের লক্ষ পণ জোগাড় করতে ঘাম ছোটায়, কিন্তু স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবিত নয় তাকে আমরা প্রশ্ন করি। কোটি কোটি ভারতীয় ভূমিকন্যারা আজও পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির নাগপাশে গোয়ালে রক্তে ভেজা কাপড় শুকোতে দেয়, মুক্ত কণ্ঠে ঘরের মানুষের সামনেও রক্তস্নানের কথা সোচ্চারে ঘোষণা করতে না পেরে ‘মেয়েলি রোগে’ জর্জরিত, যে আদিবাসী, দলিত, গরীব বধুরা রক্তে ভেসে যাওয়ার ‘লজ্জায়’ যৌনাঙ্গে বালি- কাঠের গুঁড়ো- গাছের পাতা ঠাসে আমরা তাদের হয়েই ধরে নাও তোমাদের এই খোলা চিঠি লিখছি ।

মাসিকের সময় অপরিচ্ছন্নতার জন্য হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে জন্ম দেয় জরায়ু মুখ ক্যান্সার। আজ প্রতিবছর গড়ে ৮০ হাজার মহিলা প্রাণ দিচ্ছেন এই মরণ রোগে তারপরেও যে মূলধারার সংবাদপত্র এই নারীদের বালি- কাঠের গুঁড়ো যৌনাঙ্গে ব্যবহারের খবর করতে পারে, কিন্তু দেশিয় মনসবদার পুরুষতন্ত্রের সাথে বড় পুঁজির জোটের বিপক্ষে দাঁড়াতে ভয় পায়, তাদের এই ‘নিষিদ্ধ ইশতেহার’ চ্যালেঞ্জ জানায়।

হয়তো আমাদের প্রচেষ্টায় অথবা অন্য কোনখানে অন্যভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগাতেই গড়ে উঠবে লক্ষ ‘মেয়েলি’র কারখানা। বিজ্ঞাপিত বেশিদামি অস্বাস্থ্যকর বড় পুঁজির স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রতিস্পর্ধায় গোপনে অথবা সর্বসম্মুখে স্বদেশী চরকা’র মতোই গড়ে উঠবে মাসিকের কারখানা । গ্রাম গ্রামান্তর দিয়ে কন্যাশিশু হত্যা, গণ ধর্ষণ, যৌন খুন, কুসংস্কারের শহরকে ঢেকে ফেলবে আমাদের দেড় টাকার মেয়েলি।

শুনেছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার প্রতিবাদ হয়েছিলো, কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই আমরা অনেকবেশি সংহতি অবস্থানে আছি অরুণাচলম মরুগন্থমের সাথে, যিনি একদিন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছে, অধ্যাপকদের দরজায় স্যানিটারি ন্যাপকিন সেঁটে প্রতিবাদ সাঙ্গ করেননি। যাদবপুরের প্রতিবাদীরা যে প্যাডের গায়ে আন্দোলনের কথা লিখেছিলেন, ওই দামী প্যাড ভারতের ৮৮% মহিলার কেনার সামর্থ্যই নেই।

তবে তা কাদের রিপ্রেজেন্টেশন? আমাদের প্রচেস্টা কেবল ট্যাবুর শিকল ছেঁড়া বা স্বাস্থ্য সমস্যাই নয়, তার পাশাপাশি বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া, স্বামী খেদানো, যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া ‘অসামাজিক’ নন্দিনীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। যারা ভেঙে ফেলবেই রাজার তৈরি বেড়া জাল ।

ছন্দক চ্যাটার্জি

আর অনেকেই প্রশ্ন করছেন নাম মেয়েলি কেন? এটা তো আবারও জেন্ডার বাইনারিকেই সমর্থন করা, আমাদের মতে মেয়েলি একটা হ্যাঁ সুচক চিহ্ন। হ্যাঁ আমাদের মাসিক হয়, একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, তাতে কি ? তোমাদের কিছু বলবার আছে ?

পুরুষতান্ত্রিক ভদ্রতার মুখোশ ছিঁড়ে অশুদ্ধতার মুক্তাঞ্চলে আমার মেয়েবেলা উদযাপনে আপনাদের স্বাগত…স্বাগত পরিবারের সকলকে, যে ভাই বোন বা দিদির স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত, যে বাবা মেয়ের জীবন নিয়ে পরোয়া করেন, যে স্বামী স্ত্রীর সাথে মিলেই তৈরি করতে চান স্বপ্নের সংসার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.