নাসরীন রহমান: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘‘ডিপ্রেশন অ্যান্ড আদার কমন মেন্টাল ডিজঅর্ডার্স: গ্লোবাল হেলথ এস্টিমেট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে ; ‘বাংলাদেশে ৬৩ লাখ ৯১ হাজারের বেশি মানুষ বিষাদগ্রস্ততায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ১ শতাংশ। এ ছাড়া উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছে ৬৯ লাখ মানুষ, মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমন একটা সময় তাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে যখন সামনেই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। লক্ষণীয় যে , এই প্রতিবেদনটিতে যে বিষয়টি আমাদের উদ্বেগের কারণ, তা হচ্ছে এখানে বলা হয়েছে, পুরুষের তুলনায় নারীরাই বেশি মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলভুক্ত। যেখানে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় বিষাদগ্রস্ত মানুষের হার সমান হলেও ভুটানে তা বেশি, ৪ দশমিক ২ শতাংশ। আর সবচেয়ে বেশি বিষাদগ্রস্ত মানুষের দেশ ভারত! ৪ দশমিক ৫ শতাংশ! সবচেয়ে কম পূর্ব তিমুরে, ৩ শতাংশ। এবং বিশ্বে সবচেয়ে কম বিষাদগ্রস্ত মানুষের দেশ সোলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
আর সবচেয়ে বেশি ইউক্রেনে, ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
এর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘ভায়োলেন্স এগেইন্সড উইমেন সার্ভে ২০১৫ ‘ এর জরিপেও আমরা দেখেছি সেখানে বলা হয়েছে শতকরা ৫৫% নারী বলছেন, দাম্পত্য জীবনে তারা স্বামী কর্তৃক নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন কোনও না কোনও সময়ে।
দেখা যাচ্ছে, দুটো প্রতিবেদনেই একটি অভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে, আর তা হচ্ছে বিবাহিত নারীরা বেশি মানসিক নির্যাতনের শিকার, আর তা অবধারিতভাবে স্বামী বা স্বামীর বাড়ীর কারও না কারও দ্বারা তাঁরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু বিষাদগ্রস্ততা সম্পর্কে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্যটি হচ্ছে, বিষাদগ্রস্ততার একেবারে শেষ স্তরে গিয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আমরা দেখেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা আকতার জাহান জলির এমনি করুণ পরিণতি। মেধাবী ছাত্রী নাসরিন, মডেল সাবেরার আত্মহত্যার ঘটনা; ধারণা করা হয় মানসিক বিষাদ্গ্রস্ততা থেকে তাঁরা এমনটা করেছেন। অধ্যাপিকা জলির সুইসাইড নোট এবং মডেল সাবেরার ফেসবুক পোস্ট অন্তত আমাদের এমনটা সিদ্ধান্তে আসতে সহায়ক হয়।
অতি সম্প্রতি আরও একজন মডেলের আত্মহত্যার ঘটনা নারীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিলে আর একটি সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু কেন নারীদের মাঝে এই ক্রমাগত বিষণ্ণতা? বিশেষ করে শিক্ষিত নারীদের মাঝে সাম্প্রতিক সময়ে বিষণ্ণতার সমস্যা আরও প্রকটভাবে দেখা যায়।
একসময় বলা হতো, অর্থনৈতিক মুক্তি নারীকে সকল সুখের মুখ দেখাবে; শিক্ষিত, উপার্জনক্ষম নারীদের মাঝে বিষণ্ণতার এই মারাত্মক প্রকোপ আমাদের ভাবিত করছে, উদ্বিগ্ন করে তুলছে, তাহলে প্রশ্ন উঠে, নারীর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসলে কোথায়?
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক মোহিত কামাল এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন; তিনি বলেছেন, ‘বিষাদগ্রস্ত মানুষের কোনো কিছুতে আনন্দ থাকে না। এরা কাজের উদ্দীপনা পায় না। এদের কাছে বর্তমান গ্লানিময় মনে হয়। আর ভবিষ্যৎকে মনে হয় অন্ধকার’।
এটা ঠিক চিকিৎসা শাস্ত্রও বলে, চল্লিশোর্ধ নারীরা একটা সময় এসে বিষণ্ণতায় ভোগার মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকেন, জীবনের চাওয়া – পাওয়ার হিসেব মেলাতে যেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। শূন্যতা এসে ভর করে জীবনে; হতাশায় মুষড়ে পড়েন তাঁরা। তাঁদের মানসিক এই সংকটময় সময়ে প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট; এই বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে কতটা তাঁরা মানসিক সমর্থন পান তা ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু এই বিষণ্ণতা যে নারীর সম্ভাবনাকে বিনাশ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট, তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
আমাদের বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে নারীরা এমনিতেই অবহেলিত; শারীরিক সমস্যার উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন অনেক নারী পরিবারে প্রান্তিক অবস্থানে থাকেন বলে; সেখানে এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীর মানসিক অসুস্থতা কতটা গুরুত্ব পাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শহুরে সমাজে যেখানে নারীর মানসিক বিষণ্ণতা নামের অসুখটি যথাযথ গুরুত্ব পায় না, সেখানে গ্রামের নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল, তাও সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ‘মানসিক বিষণ্ণতা ‘এই রোগটির যথাযথ চিকিৎসা না হলে তার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ , অনাকাঙ্ক্ষিত, তা আত্মহত্যাজনিত ঘটনাগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় আলোচনায় এসেই যায়, বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসার কতটা সুযোগ-সুবিধা আছে, পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন কি এই বিষয়ে? কতোটা ব্যয়বহুল এই রোগের চিকিৎসা সেবা নেওয়া? কারণ মানসিক রোগের চিকিৎসা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। রোগীর পরিজনকেও ধৈর্য ধারণ করতে হয় রোগীর সম্পূর্ণ সুস্থ না হয়ে উঠা পর্যন্ত। এই তো গেল শহরের অবস্থা; কিন্তু গ্রামে? সেখানকার চিত্রটা কী? গ্রামে মানসিক রোগের সম্পর্কে কতটা প্রচারণা আছে তা আগেই বলেছি, দেখা যায় অধিকাংশই সেখানে অজ্ঞতার কারণে মানসিক রোগীদের ঝাড়, ফুঁক বা কবিরাজি চিকিৎসা করান! তাঁদের ধারণা ‘ জিনের আছর ‘! আর কাঠমোল্লাদের পাল্লায় পড়ে এই ‘জিনের আছর’ রোগীদের সাথে চিকিৎসার নামে কী মধ্যযুগীয় বর্বরতা চলে, তা অনেক সময়ই সংবাদ শিরোনাম হয়।
গ্রামীণ এই ধরনের রোগীদের শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার ঘটনা অহরহ সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। এতে করে মানসিক রোগীর অবস্থা যে আরও শোচনীয় হয় বলাই বাহুল্য। কখনো কখনো রোগীর মৃত্যুও ঘটে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার খপ্পরে পরে।
মানসিক রোগের কারণ বা বিষণ্ণতার পেছনে একক কোনও কারণকে যেমন আমরা দায়ী করতে পারি না, তেমনি একই কারণ সকলের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে মানসিক অসুস্থার পেছনে, তাও নয়। সাধারণত যে সকল কারণে মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে তার মধ্যে আছে হতাশা, গ্লানিবোধ, অভাব, দাম্পত্যে অশান্তি, সন্দেহ ইত্যাদি। বিষাদ্গ্রস্ত মানুষ নিজেদের অপ্রয়োজনীয় ভাবেন সমাজ বা সকলের কাছে; এই হতাশা তাঁদের ধীরে ধিরে নিয়ে যায় গভীর মানসিক সংকটে, যা থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ে রোগীর জন্য, আর তাই এসময় দরকার বিষাদ্গ্রস্ত রোগীর যথাযথ মানসিক চিকিৎসা।
বাংলাদেশে নারীদের বিষণ্ণতার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে প্রধান যে কারণটিকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিরাজমান স্বেচ্ছাচারি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো। যা নারীকে ভীতি, হতাশা, বঞ্চনার মধ্যে ফেলে দিয়ে গভীর মানসিক সংকটের দিকে ধাবিত করে। নারীর এই মানসিক সংকট কখনও বা তাঁদের নিয়ে যায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আত্মহত্যার দিকে ; কখনো বা মানসিক অসুস্থ নারী হত্যা করে বসেন স্বীয় সন্তান, স্বামীকে! গতবছর আলোচিত বনশ্রীর সেই ঘটনায় দেখা গেছে ‘মা’ কে হন্তারকের ভূমিকায়!
মানসিক বিষণ্ণতা লুকিয়ে রাখার মতো লজ্জাকর কিছু নয়, কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে বিষণ্ণতায় ভোগা শিক্ষিত নারীদের অনেকেই বুঝতেই চান না যে তাদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন। তাঁরা প্রয়োজনই বোধ করেন না এই সময়ে চিকিৎসা নিতে, রোগীর অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে যাওয়ার আগে যথাযথ চিকিৎসা নিলে কিন্তু এই রোগের থেকে মুক্তি সম্ভব। তাই বিষণ্ণতাকে অবহেলা নয়; লুকিয়ে রাখা নয়, যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা জরুরী ভিত্তিতে নেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।