ডুব বিতর্ক এবং কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রতীক্ষিত ছবি ডুব -” NO BED OF ROSES ” নিয়ে মেধাবী শিল্পী মেহের আফরোজ শাওনের আপত্তির জের ধরে আপাতত সেন্সরবোর্ডে আটকে গেছে এই ছবির মুক্তি।

” ডুব ” বিতর্কে আমি কী ভাবছি তা ভাবতেই কিছুদিন পার করলাম। কেননা যে কোনো বিষয়ে দুম করে মন্তব্য করে বসাটা উচিৎ নয় বলেই আমি মনে করি। তাই অন্যান্য লেখাগুলো পড়ছিলাম, বোঝার চেষ্টা করছিলাম দুই পক্ষের বক্তব্য ও অবস্থান। ব্যক্তিগতভাবে আমি ” ফারুকী ” বা ” শাওন ” এ্যালার্জিতে ভুগছি না। সেজন্যই দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি যুক্তি বোঝার চেষ্টা করা। 

গতকাল যখন মেহের আফরোজ শাওনের বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষায় একটি ভিডিও প্রচারণা দেখলাম এবার মনে হলো কথা বলতেই হবে। শাওন সম্পর্কে এধরনের অশ্লীল উক্তি আগেও বহুবার লিখতে দেখেছি, এবারে ভিডিওবার্তায় তা শুনতে হলো। এক পর্যায়ে আমি আর সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হলাম তা বন্ধ করে দিতে। নিজের কানকে বিশ্বাস হতে চায় না – মানুষ এতো জঘন্য ভাষা কীভাবে উচ্চারণ করে? গালিগালাজ তো আছেই, সেই সাথে কত বড় দুঃসাহস না হলে সে শাওনের কাছে কৈফিয়ৎ চায় বিধবা হয়েও সাদা শাড়ি না পরার জন্য! এই  ভয়াবহ মানসিক বিকৃতিতে ভোগা ব্যক্তিটি নাকি আবার কন্যা সন্তানের পিতা! ধিক্কার তার পিতৃত্বকে।

“ডুব” প্রসংগে পরে আসছি। তার আগে প্রথম কথা হলো নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, নুহাশপল্লী – এসবে বিস্তর আগ্রহ থাকলেও আমি মনে করি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন একান্তই তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অধ্যায়। যদিও লেখকের হোটেল গ্রেভার ইন, মে ফ্লাওয়ার থেকে শুরু করে রাবণের দেশে আমি ও আমরা, রঙ পেন্সিল, আমি, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ বইগুলোতে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বহু মধুর , মজার বা তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি তিনি পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। তাঁর আশ্চর্য  যাদুকরী লেখনীতে মুগ্ধ অদেখা পাঠকের কাছে তাই হয়তো হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের মানুষগুলো খুব কাছের বা আপন হয়ে ওঠে।

কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, এই কাছের হয়ে ওঠার সুবাদে আমরা অনেকেই ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে যখন-তখন প্রিয় লেখকের ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ছি, যা খুশি তাই মন্তব্য করছি, নিজেরাই পক্ষে-বিপক্ষে দল গঠন করে বিভক্ত হয়ে পড়ছি!  কেউ গুলতেকিন খান ও তাঁর সন্তানদের পক্ষে, কেউ শাওন ও তাঁর সন্তানদের পক্ষে। অথচ একবারের জন্যও ভেবে দেখছি না লেখক বা তাঁর পরিবারের কেউ কী আমাদেরকে এই অনধিকারচর্চার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন? বরং এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে বিভিন্ন সময় হুমায়ূন পরিবারের পরিণত ও সংযত আচরণ, অভিব্যক্তি আমাদের হৃদয় ছুঁয়েছে। নুহাশের লেখা আমাদেরকে আবেগাপ্লুত করেছে।

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী

” সম্পর্ক ” আমার বিশেষ আগ্রহের বিষয়। সম্পর্কের গভীরতা,  জটিলতা, টানাপোড়ন, মায়াবী আকর্ষণ আমাকে ভাবায়। আমার  অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমি দেখি একটি মানবিক সম্পর্কের বন্ধনে, টানাপোড়নে হুমায়ূন আহমেদ, গুলতেকিন, নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ, শাওন, নিষাদ, নিনিত যে যার অবস্থান থেকে একেকজন অনন্য যোদ্ধা।
 
মানুষের মন এবং জীবন সত্যিই রহস্যময়। তেমনি ” সম্পর্ক ” বিষয়টিও জটিল এক সমীক্ষা। সমগ্র জীবনভর মানুষ নিজেও হয়তো সেই রহস্য, জটিলতা ভেদ করে নিজের জীবনের সমীকরণ বের করতে পারেনা। সেখানে অন্যের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে দূর থেকে ” জাজমেন্টাল ” হয়ে ব্যাখ্যা করতে যাওয়াটা একেবারেই অনুচিত।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই চব্বিশ ঘণ্টা শাওনকে অশ্লীল বাক্যবাণে জর্জরিত করছি – এ কেমন ধারার বাক স্বাধীনতা? গুলতেকিন বা তাঁর সন্তানেরা তো কেউ শাওনের বিরুদ্ধে কটূক্তি করছেন না কোথাও। তাঁরা তাঁদের পারিবারিক শিক্ষা, রুচি এবং ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন শুরু থেকেই। এখন আমরা কীভাবে সেসবের পরিচয় দেবো তা আমাদেরকেই ভাবতে হবে।

ইতিমধ্যে কলকাতার আনন্দবাজারসহ আমাদের দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা ধারণা পেয়েছি
যে, ” ডুব” ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবন থেকে। যাঁরা বলছেন ” হুমায়ূন আহমেদ কোনো ধর্মীয় নেতা ছিলেন না যে তাঁকে নিয়ে ছবি বানানো যাবে না” – তাঁদের বক্তব্যকে আমি সম্মান জানিয়েই বলছি যে, একজন নির্মাতার ছবির কাহিনী কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হতেই পারে, এতে কোনো অসুবিধে দেখি না। তবে যেহেতু হুমায়ূন আহমেদের পরিবার এখনো ” ইতিহাস” হয়ে যাননি, সেক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাথে আলাপ করে অনুমতি নেবার প্রয়োজন ছিলো।

যারা প্রশ্ন রাখছেন, ” অনুমতি নিতে হবে কেন?” তাদের প্রতি সবিনয়ে পাল্টা প্রশ্ন রাখলাম – একজন বিখ্যাত মানুষের ব্যক্তিজীবনের সম্পর্ক আর তার টানাপোড়েনের গল্প পর্দায় দেখাতে চাইছেন, সেই বাস্তব চরিত্রগুলোর আদলে অভিনেতাদের প্রস্তুতি নেওয়ানো হবে অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কোনো সৌজন্য আলাপ  না করেই , অনুমতি ছাড়াই  – একজন দায়িত্বশীল নির্মাতা এতোটা দুর্বিনীত কেন হবেন ?

সিনেমাতে বাস্তব জীবনের প্রতিফলন খুবই স্বাভাবিক। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই,  একজন লেখক, কবি,  কাহিনীকার  নির্মাতা সর্বোপরি একজন শিল্পীর সৃজনশীলতার রসদ জোগায় তাঁর পারিপার্শ্বিকতা। কিন্তু সেই রসদখানা যখন  খ্যাতিমান কোনো ব্যক্তিত্ব বা তাঁর জীবন থেকে নেয়া তখন দরকার কিছু গবেষণা  বা তাঁর কাছের মানুষদের সাথে,  পরিবারের সাথে আলাপ – তাঁদের পরামর্শ নেয়া, সম্মতি নেয়া ।

হতে পারে ” ডুব – NO BED OF ROSES” একটি বিশ্বমানের ছবি হতে চলেছে। মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর অনেক কাজ আগে ভালো লেগেছে 
আবার পিঁপড়াবিদ্যা সেভাবে টানেনি বা তাঁর নাটকে ” আবার জিগস ” ধরনের সংলাপে বিরক্তও হয়েছি। ” ডুব ” ছবিতে ইরফান খান, রোকেয়া প্রাচীর মতো বাঘা অভিনেতারা অভিনয় করেছেন। তিশা, পার্ণো মিত্র তাঁদের কাজ দেখার জন্যও দর্শক মুখিয়ে থাকবে।
কিন্তু একটি ছবির প্রচারণা করতে গিয়ে এভাবে জল ঘোলা করার খুব কী প্রয়োজন ছিলো?

কলকাতায় ” নির্বাসিত ” নামে একটি ছবি নির্মিত হয়েছে। ছবির গল্প আমাদের নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের জীবন থেকে নেয়া। যতটুকু জেনেছি, যদিও এটি বায়োপিক ছিলো না, তারপরও  ছবির প্রযোজক কৌশিক গাঙ্গুলি এবং নির্মাতা চূর্ণি গাঙ্গুলি ছবি নির্মাণের আগে লেখকের সাথে একাধিকবার আলোচনা করেছিলেন। তসলিমা নাসরিন ছবিটি দেখেছেন এবং কোনো আপত্তি তোলেননি বলেই জানি।

এই স্বচ্ছতা, এই সৌজন্যবোধ আমাদের নির্মাতাদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি না?
আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি অনুরোধ, দয়া করে কারো ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোর আগে আমরা যেন অন্তত একবার তার জুতোটা পায়ে গলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.