সাদিয়া আফরোজ শীতল: অনেকদিন আগে “Women Don’t Ask” বইটিতে দুটি ঘটনা পড়েছিলাম যে কেন নারীদের বিভিন্ন প্রফেশনে অংশ নেয়া উচিত, আর উচ্চপদে যাওয়া উচিত। কারণ নারী আর পুরুষ অনেককিছু আলাদাভাবে দেখে, একই সমস্যার আলাদাভাবে সমাধান খোঁজে। তাই জগতের সকল সমস্যা শুধু পুরুষরা সমাধান করলে সেটা অনেকসময়ই পুরোপুরি সমাধান হয় না, আবার অনেক সমস্যার সমাধান অজানাই থেকে যায় বিশেষ করে যেসব সমস্যায় শুধু নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কথা যে শুধু নারী/ পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য তা নয়, আসলে প্রতিটি মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা আলাদা, তাই বিভিন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠা বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক মানুষ মিলে কোনো সমস্যার সমাধান করলে তাতে অনেক বেশি মানুষ উপকৃত হয়।
এই নিয়ে একটি মজার গল্প মনে পড়ে গেল — নিকন একবার একটি ক্যামেরা বানিয়েছিল যা ছবি তোলার আগে বুঝতে পারবে মানুষের চোখ বন্ধ না খোলা, চোখ বন্ধ থাকলে ছবি তোলা যাবে না এই ক্যামেরা দিয়ে। কিন্তু এই ক্যামেরাটি বড় বড় চোখের মানুষরা বানিয়েছিল তাই চাইনিজরা ক্যামেরা দিয়ে ছবিই তুলতে পারত না!
“Women Don’t Ask” এর লেখিকা এই বিষয়ে দুইটি উদাহরণ দিয়েছিলেন: একটি হলো “stress” বা বিপদে পড়লে মানুষের আচরণ নিয়ে গবেষণা আর আরেকটা হলো হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি নিয়ে গবেষণা।
অনেকেদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে সব মানুষ বিপদে পড়লে একইভাবে আচরণ করে। তাদের ধারণা ছিল যে সামনে বিপদ দেখলে আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয় যে কারণে আমরা হয় বিপদের সাথে মোকাবেলা করি (“ফাইট”) বা পালিয়ে যাই (“ফ্লী”)। এটাকে তারা নাম দিয়েছিলেন “ফাইট বা ফ্লী” প্রতিক্রিয়া আর অনেকদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ধরেই নিয়েছিলেন যে এই শারীরিক প্রতিক্রিয়া আমাদের বেচে থাকার জন্য একান্তই জরুরি।
কেউই এই ধারণাকে ভুল মনে করেনি, বা বিপদে পড়লে মানুষ অন্য আচরণও যে করতে পারে এটাও কেউ মনে করেননি, কারণ বাকি সব বিজ্ঞানীরাও যে ছেলে ছিলেন। কিন্তু যখন দুই মহিলা বিজ্ঞানী, সেইলি টেলর আর লরা ক্লেইন, এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করলেন তখন তারা লক্ষ্য করলেন যে তাদের নারী সহকর্মীরা বিপদে পড়লে পুরুষ সহকর্মীদের থেকে একদম অন্যভাবে আচরণ করেন!
তারা বলেন, “অফিসে একটা জোক আছে যে যখন ল্যাবের মেয়েরা চাপের মধ্যে থাকে তারা সবাই একসাথে হয়ে কফি খায় আর গল্প করে, আর যখন ল্যাবের ছেলেরা টেনশনে থাকে, তখন তারা একা একা থাকে।”

যখন টেলর আর ক্লেইন খেয়াল করলেন যে এই বিষয়ে সব গবেষণা শুধু পুরুষ বিজ্ঞানীরা করেছেন, তখন তারা এই বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তাদের গবেষণার ফলাফল সবাইকেই চমকে দিল। যদিও নারীও চাপে পড়লে “ফাইট বা ফ্লী” অনুভব করেন, তাদের শারীরিক পার্থক্যের জন্য “ফাইট বা ফ্লী” প্রতিক্রিয়া সেভাবে দেখা যায় না। চরম চাপের মধ্যে পড়লে সব মানুষের শরীরে অক্সিটোসিন নামে এক হরমোন বের হয়।
অক্সিটোসিন আমাদেরকে শান্ত করে, আর সবার সাথে মেলামেশা করতে উৎসাহী করে — কিন্তু টেস্টসটেরন অক্সিটোসিনের প্রভাবকে কমিয়ে দেয়। ছেলেদের শরীরে যেহেতু অনেক টেস্টসটেরন আছে তাই বিপদে পড়লে তারা শুধু “ফাইট বা ফ্লী” প্রতিক্রিয়া দেখায়। অন্যদিকে মেয়েদের শরীরে টেস্টসটেরনের বদলে আছে এস্ট্রোজেন যা অক্সিটোসিনের প্রভাবকে বাড়িয়ে দেয়। তাই মেয়েরা চাপে পড়লে “ফাইট বা ফ্লী” প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সবার সাথে সামাজিক মেলামেশা করে।
টেলর আর ক্লেইন এই প্রতিক্রিয়ার নাম দিলেন “যত্ন এবং বন্ধুত্ব স্থাপন (tend and befriend)”। তাদের বিখ্যাত পেপারটি পড়তে পারেন এইখানে (ব্লগ পোস্ট)।
বিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র “টেন্ড এন্ড বিফ্রেন্ড” নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। অনেক বিজ্ঞানী এখন মনে করেন যে এই “টেন্ড এন্ড বিফ্রেন্ড” প্রতিক্রিয়ার জন্য মেয়েরা ছেলেদের থেকে বেশিদিন বাঁচে। এতকিছু বিজ্ঞানীদের অজানা থেকে যেত যদি ওই দুই মহিলা বিজ্ঞানী একই বিষয়কে মেয়েদের চোখে দিয়ে না দেখতেন!
নারীদের উচ্চ ক্ষমতায় যাওয়া যে কত জরুরি তার আরেকটা উদাহরণ হলো হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি। ১৯৯১ সালে ডা. বার্নাডীন হেইলি যখন NIH এর প্রধান হলেন তখন অনেক রোগ যা নারী-পুরুষ সবারই হয় সেসব রোগের ক্লিনিকাল গবেষণায় নারীদেরকে অংশ নিতে দেয়া হতো না, কারণ বিজ্ঞানীরা (বুঝতেই পারছেন “পুরুষ” বিজ্ঞানীরা) মনে করতেন যে নারীদের প্রতিক্রিয়া প্রায়ই পুরুষদের প্রতিক্রিয়া থেকে আলাদা হয়, তাতে তাদের গবেষণায় ভেজাল লাগে। তাদের এই কথা মনেই হয়নি যে এর মানে হলো একই রোগে নারীদের চিকিৎসা আলাদাভাবে করা উচিত। এছাড়া অনেক রোগ যা শুধু নারীদের হয় সেসব নিয়ে ভালো গবেষণা তো হতোই না।
ডা. হেইলি এইসব দেখে অনেক প্রশ্ন তুলতেন, তারপর প্রতিষ্ঠা করলেন “ওইমেন হেলথ ইনিশিয়েটিভ” যেখানে নারীদের রোগ নিয়ে গবেষণা করা হবে। এর প্রায় ১০ বছর পর NIH এর এক গবেষণায় জানা গেল যে এতোদিন ধরে নারীদের কথা আলাদাভাবে চিন্তা না করে এক বিশেষ হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি দেয়া হতো যাতে মেয়েদের স্তন ক্যান্সার, হার্ট এটাক, রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। সেই সময় ৬০ লাখ নারী নারী হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপিতে অংশ নিয়েছিলেন, ডা. হেইলির উদ্যোগের কারণে অন্তত ২৫০০০ নারী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
NIH এ এর আগে অনেক বড় বিজ্ঞানী এসেছিলেন, কিন্তু তারা নিজেরা পুরুষ ছিলেন বলে মেয়েদের সমস্যার কথা আলাদাভাবে চিন্তাই করে দেখেননি।
এই দুটি উদারহণ থেকে বোঝা যায় যে নারীরা কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদে অংশ নিলে শুধু যে তাদের নিজেদের লাভ, তা নয়, এতে আমাদের বিজ্ঞানের এবং সমাজেরও লাভ কারণ নারী অনেককিছু অন্যচোখে দেখে। মেয়েদের অংশগ্রহনে তাই আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি হয় — আর অনেকক্ষেত্রে এই উন্নতি অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে।
আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশেও এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে একজন নারী অনেকক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছেন যা পুরুষের পক্ষে করা অনেকটাই অসম্ভব ছিল — বেগম রোকেয়া ছিলেন বলেই নারীশিক্ষা আজ এই পর্যায়ে এসেছে, জাহানারা ইমাম ছিলেন বলেই একাত্তরে ছেলে হারানোর কষ্টকে আন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছিলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানে নারী-প্রধান আছেন বলেই অনেক নারীকর্মী নিরাপদে কাজ করতে পারেন। আপনারা যদি এমন কোনো নারীর গল্প জেনে থাকেন, সবার আগে তাকে অভিনন্দন দিন আর আশেপাশের সবার সাথে তার গল্প শেয়ার করে অন্য নারীদেরকেও কর্মক্ষেত্রে অংশ নিতে উৎসাহিত করুন। একজন নারীর সাফল্য আমাদের সবার সাফল্য।
লেখক: পোস্টডক UC Berkeley, পিএইচডি করেছেন ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি থেকে।