চেনা অপরিচিতা: শিশু পালন ব্যাপারটায় ধারণা ছিল না কোন, আগেই বলেছি। আমার স্বামীর বোনেরা মূলত দেখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে গোসল করাতে হয়, কান, জননেন্দ্রিয় পরিষ্কার পরতে হয়, গোসলের পরপরই তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে কীভাবে সব জায়গা পানিমুক্ত করতে হয়, ছোট ছোট নখ কাটতে হয়।
প্রথমদিকে ভয় ভয় লাগতো। আমার শাশুড়ির অনেক নাতি-নাতনী, কিন্তু কাউকে তিনি দেখভাল করতে পারেননি। শিশুদের ব্যাপারে তিনি সেনসিটিভ। তিনি তার বদলে রান্না ঘর আর সংসারের অন্যদিক সামলাতেন।
আমি যখন একা একদিন বাচ্চাকে গোসল করাচ্ছি তখন তিনি বললেন, “ পারবা?” আমি বললাম, “আমার বাচ্চা আমাকেই তো পারতে হবে।” হ্যাঁ, তাই তো। আমার বাচ্চাকে দেখতে আমার বাবা-মা কেউ তো আসবে না। বড্ড বেশী ঘেন্না, বিতৃষ্ণার ভিড়ে নাড়ির টান ফিকে হয়ে গেছে। একরাশ অভিমান, কষ্ট যন্ত্রণা বুকে পুষে ছোট্ট একটা বাচ্চাকে আনাড়ি হাতে গোছাতাম।
ছয় মাসের ছুটি যখন শেষের দিকে টেনশনে ঘুম আসতো না। বাবুকে রেখে কীভাবে অফিস করবো। কর্মক্ষেত্র ভিন্ন শহর। কর্তৃপক্ষ সব জানতেন। তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমার শহরে আমাকে ট্রান্সফার করলেন ছুটির পরপরই। কিন্তু ঐ ক’ঘণ্টা বাচ্চা দুধ ছাড়া কীভাবে থাকবে? প্রথম দিকে অফিস থেকে গিয়ে বাসায় দুধ খাইয়ে আসতাম। বাসা কাছে নিয়েছিলাম এ কারণে। পরে দুধ রেখে আসতাম। সাথে সকালে খিচুরি রান্না করে আসতাম।
প্রায় বছরখানেক হাফ ডে অফিস করেছি। এই নির্দোষ অন্যায়টা করেছি শুধুই মেয়ের জন্য। নির্দোষ বলছি এজন্য যে কাজ বাকি রেখে বা কাজে ফাঁকি দিয়ে যাইনি কখনও। তবু এ নিয়ে কথা উঠলো একদিন। এই অপমানকর দিনটা একদিন আসবে জানতাম। তাও কান্না পেলো। বাচ্চার জন্য মা’রা ভয়াবহ স্বার্থপর।
যাই হোক, ততোদিনে বাচ্চা দুধ ছাড়াও অনেক কিছু খেতে শিখেছে। আমি ফুল ডে অফিস শুরু করলাম। মাঝে মাঝে কাজের লোক বা বাড়িতে যখন কেউ থাকতো না, তখন বাচ্চাকে সাথে নিয়ে অফিস করেছি। বাচ্চা ঘুমে ঢলে পড়লে কোলে রেখে বা পাশে দুটো চেয়ার দিয়ে শুইয়ে রেখে কাজ করেছি। আমাকে কি তখন খুব অসহায় লাগতো? অফিস কর্তৃপক্ষ প্রায়ই এমন হলে ছুটি দিয়ে দিত। পরে অফিসের গেস্ট রুম খুলে দেওয়া হতো। বাচ্চার সাথে একটা ছোট মেয়ে সাথে থাকতো।
সবচেয়ে অসহায় লাগতো, যখন বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়তো। বাসায় সাহায্যকারী কেউ থাকতো না। অফিস করে এসে, পুরো ঘর ঝেরে মুছে, বাথরুম ধুয়ে দেখতাম, বাচ্চার লুজ মোশনের ফল মেঝেতে জায়গায় জায়গায়। এক জায়গায় মুছতাম, আরেক জায়গা নষ্ট হতো।
পহেলা বৈশাখ প্রথম গেলাম নয় মাসের মেয়েকে নিয়ে মায়ের বাড়ি। মেয়ে ভয়াবহ রকম কান্না করলো। কিছুতেই আমার মায়ের কোলে যাবে না। শুধু ঐদিন নয়, ঈদে বা যখন যখনই নিয়ে যেতাম কিছুতেই কাছে যেতে চাইতো না মেয়ে। সামনে আসলেই হেঁচকি তুলে কান্না। তাও আম্মা শেষে কোলে নিতে পেরেছিল, কিন্তু মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মেয়ের কারণেই বেশিক্ষণ থাকা হতো না।
মাঝে মাঝে ভাবি, মা তো ভালবাসবেই, কিন্তু তার অহং আর আজন্ম লালিত জেদের পাহারায় আমারা আলাদা থাকতাম।
মেয়ের প্রথম জন্মদিনে দাওয়াত করতে গেলাম। আম্মা শুয়ে ছিল। সাধারণত শুয়েই থাকে যখনই যাই। কিন্তু সেদিন দুর্বল লাগছিল। আমি জন্মদিনের দাওয়াত দিলাম, কার্ড দেখালাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কার্ডটা কি এখানে রাখবো? নাকি বাবাকে দেখাবো? আম্মা কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে কনফিউজিং একটা উত্তর দিল। আমি আমার বাবার কাছে গেলাম। দাওয়াত দিয়ে ফের এলাম মায়ের কাছে। আম্মা বললো, তার শরীরটা ভাল না। হিমোগ্লোবিন কম। পায়খানা হচ্ছে না। ডাক্তার কলন্সকপি করতে চাইলেও হিমোগ্লোবিন কম থাকায় করতে পারেনি। ডাক্তার রক্ত নিতে বলেছে।
আমি বললাম, “কবে রক্ত নিবা? শুক্রবার হলে ভালো হয়, এসে রক্ত দিয়ে যাবো”। আমার আর আমার মায়ের ব্লাড গ্রুপ অভিন্ন। আমার কথা শুনে তাদের চোখে বা কথায় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। আমার বাবাকে বলতেই বললো, “তোমার আম্মাকে বল।”
আমি আম্মাকে বললাম, “শুক্রবার সকালে তাহলে চলে আসবো”। এটা শুনে আম্মা বললো, “আগেই এসো না, ফোন করলে এসো”।
আমি এটুকু অন্তত বুঝতে পারছিলাম, ওনারা আমাকে অ্যাভয়েড করছেন।
শুক্রবার সকালে থেকে একঘণ্টা পর পর ফোন করলাম। আমার বাবা মিথ্যে করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগলেন, “আসলে মা, এখনও কিছু ঠিক হয়নি।“
বিকেলে জানতে পারলাম বাইরের একজন ডোনারের কাছ থেকে আমার মা রক্ত নিয়েছেন। আমি সবার কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, “আমার মা, যার গর্ভে আমি ১০মাস ১১দিন ছিলাম, যার রক্ত আর আমার রক্ত এক, সেও যখন ঘৃণা ভরে আমার রক্ত প্রত্যাখ্যান করে, যখন বাবা মিথ্যার মোড়কে সন্তানের কাছে এই অমানবিক অপমান ঢাকার তুচ্ছ চেষ্টা করে, তখন সেই সন্তানের যন্ত্রণা কী আর কতখানি হতে পারে, সেটার আন্দাজ কি কারো আছে?
আমি জানি, কেউ বুঝবে না। আমি যদি এভাবেও জাস্টিফাই করতে যাই যে আমার মা আমাকে ভালবেসে রক্ত নেয়নি। কারণ মা হয়ে সন্তানের রক্ত কিভাবে নেবে, তাহলেও আমার যন্ত্রণার উত্তর মিলবে না। কারণ এরপরও প্রতিটা পদক্ষেপে আমি তাদের জন্য যা-ই করতে চেয়েছি, চরম অপমান আর অবহেলা ছাড়া আর কিছু জোটেনি। এমনকি আমার ভাই এর কাছে তাদের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চাইলেও সেও আমাকে সাহায্য করেনি। মুখের উপরেই ভাই বলেছে, “আমি পারবো না”।
আম্মার অসুস্থতা দেখে খুব খারাপ লাগলো। আমি নেট ঘেঁটে শহরের বেস্ট এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট খুঁজে বের করে মার বাসায় ফোন করলাম। কয়েকবার ফোন করেও মায়ের সাথে কথা বলতে পারলাম না। আমার বাবাই খালি ফোন ধরছিল। একবার বলে বাথরুমে, আবার বলে ঘুমে। শেষে বাবাকেই সেই লিস্ট অনুরোধ করলাম লিখে রাখতে। এবং বললাম, যদি আপত্তি না থাকে সেখান থেকে কোন ডাক্তার দেখাবে সেই ডাক্তারের কাছে আমি আম্মাকে নিয়ে যেতে চাই। তারা কিছুই জানালেন না।
এর মধ্যে ঈদ এলো। মেয়েকে নিয়ে গেলাম মাকে দেখতে। মেয়ের কান্নাকাটিতে বেশিক্ষণ থাকাও হলো না। তখন জানতে পারলাম আমার ডাক্তার খোঁজা সম্পর্কে আমার মা কিছুই জানেন না।
আমার বাবা কি আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিলেন আমাকে? ঐ দুর্বল সময়ে যদি আমার মা আমাকে কাছে টেনে নেন?
একদিন অফিসে খবর পেলাম আমার মা হাসপাতালে। আমাকে বাড়ি থেকে কেউ জানায়নি। এলাকার এক আপা আমার খালাকে জানান। আমার খালা জানান আমাকে। শুধু হাসপাতালের নাম শুনি। কোথায় কোন ওয়ার্ডে জানা যায় না। আমি পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটি। ওয়ার্ডে গিয়ে মাকে খুঁজি। পাই না। কেবিনের কাছে লাগোয়া রিসিপসন। ওখানে গিয়ে জানতে পারি, বেড খালি না থাকায় আজ ফিরে গেছে। আমি ফিরে আসতে আসতে ভাবি, আমার মা যদি আজ দেখতো, কীভাবে তাকে খুঁজেছি, হায় বিধাতা!
(চলবে…)