সীমা দে: গত একুশে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো উইমেন মার্চ, তখন থেকেই ভাবছিলাম লিখবো আর কদিন আগে উইমেন চ্যাপ্টারে “মাতৃত্ব কি নারীর ক্যারিয়ারের অন্তরায়” লেখাটা পড়ে আরও বেশি তাগিদ অনুভব করলাম লেখার।

আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই গণ-সমাবেশে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে নারীরা মূলত এক হয়েছিল তাদের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিভিন্ন বক্তব্য আর কটূক্তির জবাবে নিজেদের অবস্থানটা পরিষ্কার করার জন্য, বিশেষ করে নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য। আর অন্যদিকে আমরা সমাজের ভাল মেয়ের তকমা নিয়ে দিনের পর দিন অসংখ্য কটূক্তি (কখনও রাজনৈতিক, কখনও ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে) হজম করে নিজেদের আত্মসম্মানকে ধূলিসাৎ করছি।
কিন্তু কেন? নারীরা যদি আমেরিকাতে এটা করতে পারে, তবে এমন তো নয় যে বাঙ্গালী নারীরা তাদের থেকে কাজে বা যোগ্যতায় কোথাও পিছিয়ে আছে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় ভূমিকা রেখে চলেছে গার্মেন্টস সেক্টর, যেখানে মূলচালিকা শক্তিই হল নারীরা। আর এখন তো সর্বোপরি সকল পেশাতেই নারীরা সফল তাদের মেধা আর যোগ্যতায়। তবুও কিছুতেই যেন আমাদের গায়ে কিছু লাগেনা(শফি হুজুরের তেঁতুল তত্ত্ব, বিয়ের বয়স নির্ধারণ, পাঠ্যপুস্তকে মধ্যযুগীয় ধারনা, এমন আরও কত কি),হয়না কোন জোর প্রতিবাদ, আসলেই কি আমরা সাহস নিয়ে ভুলকে ভুল বলতে ভুলে গেছি। আমার ধারণা মতে বাঙ্গালী শ্রমজীবী নারীরা তাদের সম্মানের জন্য রাস্তায় নামলে সেটাও আমেরিকার উইমেন মার্চ থেকে কম হবে না।
সে যাই হোক, আমার লেখাটা কোন বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কের নিচু মানসিকতার জবাবে নয়, বরং আগামী দিনগুলোতে আমাদের নারীরা যেন সন্তানের মা হয়েও নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাদের কাজের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে আর রাষ্ট্রও তাদেরকে যেন তাদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে সে বিষয়ে।
মা হওয়াটা প্রতিটা নারীর জন্যই আকাঙ্ক্ষিত কিন্তু আমাদের সমাজে নারীর এই আনন্দ অনেক সময় হয়ে যায় তার সীমাবদ্ধতা। তাই লেখিকা মোহছেনা ঝর্ণার সব কথাতেই আমি একমত। কিন্তু উনি শুধুমাত্র সমস্যাটাতেই আলোকপাত করেছেন, তার সমাধানে নয়। ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেই সন্তান জন্মের পর জাপানে নিজের পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছি কিন্তু দেশে ফিরে কোন চাকরিতে যোগদান করতে পারিনি।
আমার সবটা সময় আমার সন্তানের জন্য যা প্রতিটা মায়ের জন্যই অনেক সুখের কিন্তু দিনশেষে এটাও সত্যি যে অনেক করে চাই নিজের ক্যারিয়ারকে। কারণ আমি কারো স্ত্রী বা আমার সন্তানের মা এটা যেমন আমার একান্ত নিজস্ব একটা পরিচয়, ঠিক তেমনি আমার ক্যারিয়ারটাও আমার একটা পরিচয়। আমার মত অনেকেই হয়ত সন্তানের সঠিক লালন-পালন করতে বা সন্তানের দেখাশোনা করার লোকের অভাবে মা হবার পর থেকে আর চাকরির কথা ভাবতে পারছেন না। তাই একটা জিনিস খুব ভাবাচ্ছে যে, আমার সন্তান কি কেবলই আমার?
আমি যদি আমার কাজে এই রাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল রাখতে পারি, আমার আয়ের জন্য কর দিতে পারি তবে আমি কি কিছুই আশা করতে পারিনা রাষ্ট্র থেকে? কারণ আমার সন্তানও অদূর ভবিষ্যতে এই রাষ্ট্রের হয়েই কাজ করবে। উন্নতদেশগুলোতে তাদের নাগরিকদের জন্য যে সুযোগ সুবিধাগুলো থাকে (যেমন বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠার জন্য সকল সুবিধাপূর্ণ দিবাযত্ন কেন্দ্র), আমি আমার দেশের সরকারের কাছে তেমন কিছুই চাইছি না। আমার চাওয়া কেবল এটাই যে সরকার চাইলেই পারে, যেসকল সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মজীবী আছেন, সেখানে তাদের সন্তানদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র (মধ্যম মানের হলেও) বাধ্যতামূলক করা।
কারণ আমি মা হিসেবে চাই আমার সন্তান আমার কাছাকাছি থেকে আমার মূল্যবোধগুলো নিয়ে বড় হবে, কোন কাজের লোক বা আমার মা/শাশুড়ির কাছে নয়। আমাদের সময়ে আমরা অনেকেই একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি, তাই একা বেড়ে উঠার কোন সুযোগ ছিলনা। আর আমার মা গৃহিণী হওয়ায় (সে সময় নারীদের কর্মক্ষেত্রে এতটা বিচরণ ছিলনা) উনি সবসময়ই কাছে ছিলেন। কিন্তু এখনকার চিত্র আলাদা, নারীরা শিক্ষিত ও যোগ্য হয়ে নিজের পরিবার তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছে।
তাই মা হয়ে আমার চাওয়া, নিজের ছেলেকে চোখের আড়াল করে(ও কি করছে, খেয়েছে কিনা, ব্যথা পায়নি তো ভেবে) অস্থির না হয়ে আমি যেন স্বপ্ন দেখতে পারি নিজের ক্যারিয়ারের। আমার মাকে তো দেখেছিই কিন্তু নিজে যখন মা হয়েছি তখন সেটা আরও বেশি অনুভব করি সেটা হলো মায়েরা কখনও ক্লান্ত হয়না। তাই আমরা মায়েরা যদি সংসার সামলানোর পাশাপাশি নিজেদের সন্তানকে মানুষ করতে পারি তবে আমার দৃঢ়বিশ্বাস আমরা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজও ঠিকভাবে করতে পারব।
সব কিছুর পরও সত্যিটা হচ্ছে আমার মত মায়েরা যারা নিজেরদের সন্তানকে কাছে রেখে আবার কাজে ফিরতে চায়, সেটা বাস্তবে প্রতিফলন ঘটানো অতটা সহজ নয়। সেই কঠিন কাজটা সহজ করার জন্য দরকার সরকারের সহযোগিতামূলক মনোভাব। তবে সরকারে আশায় বসে না থেকে মানবাধিকারকর্মীরা যদি বিষয়টা সামনে নিয়ে আসতে পারেন তবে আশা করি কিছুটা হলেও এই সমস্যার সমাধান হবে।
তাই এই বিষয়ে আর সমঝোতা না করে অন্তত নিজেদের সন্তানের জন্য আমাদের সবার উচিত কণ্ঠ মিলিয়ে জোর দাবী জানান – সন্তানের জন্য মায়ের কর্মস্থলে দিবাযত্ন কেন্দ্র চাই যাতে করে প্রতিটা মা নির্ভাবনায় কাজ করতে পারে।
অটুট থাকুক মা আর সন্তানের সম্পর্ক।