‘তুমি মোটেও অসুন্দর নও’

রাবেয়া জাহান আভা: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর কয়েকমাস পরেই যে মেয়েটি পাশ করে বের হবে তার জন্য বাবা-মা পাত্র খুঁজছেন বিয়ে দেবেন বলে। মেয়েটির নিজের পছন্দের কোনো পাত্র নেই। তাই পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করাতে সময় লাগছে অভিভাবকদের। মেয়েটির পড়াশোনা, পারিবারিক পরিচয় সব মিলিয়ে পাত্র পেতে তো সময় লাগারই কথা।

কিন্তু মেয়েটি বিষণ্ণ কারণ তার গায়ের রঙ শ্যামলা। সে ধরেই নিয়েছে যেহেতু রঙ শ্যামলা তাই সে দেখতেও অসুন্দর। তার আফসোস আর দশটি বান্ধবীর মতো কেন তার নিজের কোন পছন্দের কেউ নেই। সে ভুল করেছে নিজে পছন্দ করেনি বলে। সে মন দিতে পারেনা কোন কাজে। বিষণ্ণতা অনুভব করে সবসময়। হতাশ সে জীবন সম্পর্কে। চারপাশে বন্ধুবান্ধবীদের প্রেমের যে সম্পর্ক সে দেখছে প্রতিমূহুর্তে, তাতেই তার মনে হয়েছে জীবনের সব সুখ বুঝি ওখানেই।

রাবেয়া জাহান আভা

অনেকদিন আগে কোন এক বিকেলে টানা চোখ, মায়াভরা সুন্দর মুখশ্রী আর ছিমছাম গড়নের এই মেয়েটিকে দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছিলো। কেন জানি এক ধরণের মায়া অনুভব করেছিলাম ওর জন্য। হতে পারে আমার ছেলেটিকে খুব আদর করেছিলো বলে অথবা বেশ নম্র আর বিনয় দেখেই। গতকাল এই মেয়েটিই যখন নিজের চেহারা আর রঙ নিয়ে খুব হতাশা নিয়ে আমাকে লেখে  ‘শ্যামলা মেয়েদের বিয়ে হওয়া খুব কঠিন, না?’ আমি সত্যিই অপ্রস্তুত হয়ে যাই। সত্যি বলতে, বিয়ের সময় রঙ নিয়ে আমি নিজে কখনো এইরকম বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। হয়তো নিজের পছন্দ ছিল বলেই। তবে তার জন্য যে আমাকে কথা শুনতে হয়নি তা কিন্তু না। পছন্দ করে বিয়ে করেছি বলেই এটাও শুনতে হয়েছে, ভালো চাকুরে ছেলের জন্য অনেক উচ্চবিত্ত আর সুন্দরী মেয়েদের ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।

শুধু শ্যামলা নয় বরং ফর্সা মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলেও যে কতরকম বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এটা ফর্সা বা শ্যামলা রঙ নয়, বরং আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের দেখার দোষ। একটা মেয়েকে নিয়ে বেনিআসহকলা’র রঙয়ে রংধনুর নানা রঙ খেলে তাদের মগজে।

শ্যামলা বা কালো হলে চাই ফর্সা, ফর্সা হলে চাই শিক্ষা, বাবার টাকা। শিক্ষা বেশি থাকলেও সমস্যা। শিক্ষা কম থাকলে চাই টাকা। বয়স বেশি হলেও সমস্যা। পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে দিতে গেলে একটা ছেলের পরিবার মোটামুটি নাস্তানাবুদ করে ফেলে মেয়ের পরিবারকে।

আমার বলতে দ্বিধা নেই, পুরুষশাসিত সমাজের পাওয়া কোন এক সময়ের অবহেলিত নারীরাই মূলত এই খুঁতগুলো খুঁজে বের করেন, আর তার সহায়ক ভূমিকা পালন করেন ছেলের বাবা, ভাই বা পুরুষ আত্মীয়স্বজন। মেয়েটিকে খুঁটিয়ে দেখার গুরুভার নারীদের উপর থাকলেও তার সাথে সংগতি রাখতে আর্থিক লেনদেনের হিসাব মেলান মূলত তারাই।

আমি যতদূর জানি, ভালো চাকুরে বাবার স্বচ্ছল পরিবারের এই মেয়েটির আর্থিক কোন অসঙ্গতি নেই। তবু মেয়েকে পাশ করার আগেই সুপ্রাত্রস্থ করতে চাওয়া শুধু নয় বরং অভিভাবকদের জন্য একটা বড় চিন্তার কারণও বটে। কারণ পাশ করে ফেললে মেয়েটির বয়স বেড়ে যাবে। পাওয়া যাবে না সঠিক পাত্র। আমাদের সমাজের নিয়মের এই গ্যাঁড়াকলে আমরা আটকে আছি সেই আদ্যিকাল থেকে। যদিও পরিববর্তন আসছে।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এই মেয়েটিকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি, আগে নিজের পায়ে দাড়াও মেয়ে। করো কিছু নিজের জন্য, বাঁচো নিজের মতো করে। নিজে কিছু হতে চেষ্টা করো। জানিনা সে বুঝলো কিনা। কিন্তু তার গায়ের রঙ নিয়ে সমাজের দেয়া অল্প কয়েকদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই তার উত্তর, নিজে কিছু করলে আর বিয়েই করবে না। হয়তো তার এ অভিমান ওই সমাজের প্রতিই।

মেয়ে আমি তোমাকে বলতে পারিনি, শুধু পছন্দ করে বিয়ে করেছি বলেই কতো ত্যাগ আর সমঝোতা করতে হয়েছে আমাকে, করতে হয় অনেককে। দুপক্ষে কতোকিছুর হিসেব মেলাতে হয়। ভালোবাসার আশ্রয় হারিয়ে যায় কখনো কখনো। প্রেমের সম্পর্কের যে আনন্দ আর সুখ দেখে তুমি নিজেকে অযোগ্য ভাবছো, সেটাই তো জীবন নয়। জীবন তো আরো অনেক কিছুর সাথে জড়িত। তুমি শুধু আনন্দ দেখেছো। যে বেদনায় ভরা থাকে জীবনের আরো অনেকগুলো দিন, তার দেখা তুমি পাওনি। জীবন থেকে যে দিনগুলো আমার হারিয়ে গেছে আজ তা তোমার হাতে। তাকে তুমি নষ্ট হতে দিও না। শ্যামলা সুন্দর মেয়ে, পৃথিবীর সকল শুভকামনা তোমার জন্য।  

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.