দীনা ফেরদৌস: একটি শিশু সন্তান যখন মেয়ে হয়ে জন্ম নেয় সমাজ তখন থেকেই তাকে ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ফেলে দেয়। সুস্থ, সুন্দর ছেলে হলে সে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে চলে যায়। ছেলের কোনো সমস্যা থাকলে সে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। আর মেয়ে দিয়ে যেহেতু বংশের বাত্তি জ্বালানো যায় না, তাই তাকে বাধ্য হয়ে ‘সি’ ক্যাটাগরিটাই মেনে নিতে হয়।
কথাটি আমার না, আমাদের জন্মলগ্ন থেকে মগজের মধ্যে অবচেতনভাবে যা ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তাই রিপিট করলাম। তার মধ্যে কোনো মেয়ে যদি এর বাইরে গিয়ে ‘এ’ এবং ‘বি’ ক্যাটাগরিকে টেক্কা দেবার যোগ্যতা অর্জন করতে চায়, তবে প্রথমে তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলবে, পুরুষশাসিত সমাজ ও পুরুষের প্রতিনিধিত্বকারী নারী সমাজের পক্ষ থেকে।
আর তাতে ব্যর্থ হলে তাকে সোজা ‘পি’ (প্রস্টিটিউট বা যৌনকর্মী) ক্যাটাগরিতে ফেলে দেয়া হয়। সেটাও নির্দ্দিষ্ট রাখা আছে। আমাদের বাপ-ভাইয়ের হাতেই তো তৈরি করা এসব নিয়ম, তাই মেয়ে বড় হতে হতেই তার হতে ধরিয়ে দেয়া হয় অসংখ্য ‘না করতে পারা বিষয়ের’ লিস্টি, যাতে ‘পি’ ক্যাটাগরিতে পড়তে না হয়।
কী করতে পারা যায় তা কেউ বলে না, বললে যদি তেনারা পিছিয়ে পড়ের, সে ভয়’তো আছেই।
যেমন সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরতে হবে, বিড়ি-সিগারেট মেয়েদের জন্য না, ছোট চুলে মেয়েদের বিশ্রী লাগে, টাইট পোশাকে চোখে লাগে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব বিশ্রী লাগাতো একদিনে তৈরি হয়নি, দীর্ঘদিন মগজে গেঁথে দেয়ার ফল। আর আমরা মেয়েরা এইসব নিয়ম মেনে চলি বলেই সমাজের চোখও তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মেয়েদের যা দেখলে বিশ্রী লাগে, চোখে লাগে, মানায় না, সহজ ভাষায় ধরে নিতে হবে সমাজের চোখে তা অভ্যস্ত না। দশজন মেয়ে যা কিছু সাহস করছে না, সেখানে কেউ একজন সব বিশ্রী লাগা গায়ে না মেখে, ঘন, কালো, লম্বা চুলে কাউকে হারিয়ে যাবার সুযোগ না দিয়ে চুল ছোটো রাখছে, তা আর কারো কাছে খুব সাধারণ শখের বিষয় হলেও আমার কাছে তা এইসব বিশ্রী লাগার বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরই এক ভাষা।
এইসব চোখে লাগা, বিশ্রী লাগার বিষয় যে শুধুই একটি ধারণা মাত্র, তা বলে কয়ে বুঝানো কঠিন। সেজন্যই আমাদের বেশি বেশি করে তাই করতে হবে যা করতে চাই। আজ থেকে আমরা নিজেদের স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ কাজে-কর্মে প্রয়োগ করলে, এখন থেকে পনেরো বছর পর তা অনেক সহজ হয়ে যাবে। যারা করার তারা অনেক সমালোচনার মধ্যেই করছেন, করবেন।
যারা করতে চান, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে সাহস করতে পারছেন না, তাদের উদ্দেশ্যে এই বলা (যারা কিছু করতে চান না, করিয়েন না, শুধু যে নিজের মতো কিছু করছে তার জায়গা থেকে, তার পিছনে লাগা থেকে বিরত থাকুন বইনেরা আমার)।
ইচ্ছামতো ছোটখাটো বেমানান কিছু দিয়ে চাইলেই শুরু করা যায়। ঢাক-ঢোল পিটানোর কিছু নেই এখানে। কেউ বলতেই পারে নতুন পাগলের আমদানি, কেউ বলতে পারে নানামুখি শখ, বেমানান লাগছে। আপনি জেনে রাখুন এটা একটা প্রতিবাদের ভাষা। চোখ অভ্যস্ত করার মিশন।
নিউইয়র্কে যখন প্রথম আসি, তখন মেয়েদের সাজপোশাকে কিছু পুরুষদের দেখতাম প্রায়ই। ননদের কাছ থেকে জানলাম এরা হিজ়ড়া না। নিজেদের মেয়ে ভাবতে পছন্দ করে তাই এ সাজ (আলাদা লম্বা চুল, সেলুনে যেয়ে মেয়েদের মতো ডিজাইন করা নখ, ড্রেস,মুখে কড়া মেকআপ, জুতা সব)। অথচ দেশে দেখে আসছি যে ছেলে একটু মেয়েদের সুরে কথা বলে, একটু হেলেদুলে হাঁটে, তাকে নিয়ে লোকজনকে হাসাহাসি করতে। মেয়ে হয়ে যাচ্ছো বলে তামাশা করতে।

আমার ননদ বলল, দেশে থাকতে তাদের পাড়ায় এই রকম এক ছেলে ছিলো। সে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে নাচতো, গান করতো মেয়েদের সাথে। নানাজন নানা কথা বলতো। শেষে ওই ছেলের পরিবারের লোকজন নিজেদের প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেয়। কোনো এক সময় সে আট-দশটা পুরুষের মতো সংসারি হয়ে গেলো। তার বউয়ের ঘরে বাচ্চা-কাচ্চাও হয়।
আমার প্রথম দেখাতে একটু ব্যতিক্রম লাগলেও এখন স্বাভাবিক লাগে। আর দেশে আমাদের বাপ-ভাই, স্বামী-সন্তান যারা, মেয়েদের রাত করে ঘরে ফিরলে বা সিগারেট খাওয়া দেখলে কিংবা ছোট চুলে দেখলে মনে করেন বেশি ফাস্ট হয়ে গেছে, বা নষ্ট হয়ে গেছে বলে উন্মাদের মতো নাচেন, তারাও বিদেশে আসলে অর্ধবুক খোলা জামা বা মিনি স্কার্ট পরা মেয়ে, মদ্যপ নারী, লাল-নীল-বেগুনী চুলের বয়স্ক মহিলাকে দেখে এক সময় আর তাকাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
কথা হচ্ছে, চোখকে অভ্যস্ত করে তোলা।