অচিন্ত্য সাহা: খাদিজা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল, যে একজন মানুষ কতটা হৃদয়হীন হলে আর একজন মানুষকে কুপিয়ে মারার চেষ্টা করতে পারে। চেষ্টার কথা বলছি কারণ খাদিজা শেষপর্যন্ত মরে নাই, সে শতকরা পাঁচ ভাগ বাঁচার সম্ভাবনা নিয়েই ফিরে এসেছে জীবনে, এখন অনেকটাই সুস্থ। কথার মাঝখানেই পাশে বসা আমার একজন কলিগ তার মোবাইলে ফেসবুক থেকে নেওয়া খাদিজা আর বদরুলের একসঙ্গে তোলা পিকচার দেখালো।
কলিগ বলছিলেন, এমনি এমনি তো একজন আর একজনকে কুপিয়ে মারে না। খাদিজার দোষ ছিল বলেই বদরুল এমনটা করেছে। ঠিক তখনই প্রথম কলিগের সুরে সুর মিলিয়ে সামনে বসা আর একজন কলিগ বললেন, দোষ খাদিজারই ছিল। সে দীর্ঘদিন বদরুলের সাথে প্রেম করেছে। এখন খাদিজার বাবা অন্যত্র বিয়ে ঠিক করায় খাদিজা বদরুলকে এড়িয়ে চলতো। প্রেম করবা, মজা নিবা, বিয়ে করবা না, তা তো হয় না।
কী অদ্ভুত, দিনে দুপুরে মাংস কাটার চাপাতি দিয়ে একজন মানুষকে কী নৃশংসভাবে কুপিয়ে মারার চেষ্টা করা হলো, আর সেই অমানুষটার পক্ষ নিয়েও মানুষ কথা বলে, যুক্তি দাঁড় করায়। একটা সময় মেজাজ খারাপ হতো, তর্ক জুড়ে দিতাম। কিন্তু এখন কিছুই বলি না।চুপচাপ শুনি। কারণ কোন কিছু বলেই লাভ নেই। এ জাতীয় পুরুষগুলোর ভিতর সফটওয়্যার এমনভাবে ইন্সটল দেওয়া যে, কোনো সেটআপেই এদের প্রোগ্রামের কোনো হেরফের হয় না।
ঘটনা যায় ঘটুক না কেন আগু পিছু না জেনেই এরা মেয়েদেরকে দোষী বলে রায় দিয়ে দেয়। এবং দুঃখের বিষয় যে দশজন পুরুষের মধ্যে আটজন পুরুষই একই মানসিকতা পোষণ করে।
আমি বুঝি না একটা ঘটনার পুরোটা না জেনে মানুষ কেন তার ডালপালা ছড়াই। কথার প্রেক্ষিতে ধরেই নিলাম বদরুল আর খাদিজার মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। এবং কোনো একটা পর্যায়ে খাদিজাই চাইছিল না সম্পর্কটা আর কন্টিনিউ করতে। সেটা খাদিজার পারিবারিক সমস্যার কারণেও হতে পারে, আবার সম্পর্কের ভিতর তৈরি তিক্ততাও হতে পারে। আমার কথা কোনো ধরনের তিক্ততা না বাড়িয়ে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে চাওয়াটা দোষের কেন হবে? নিজেকে ভাল রাখতে চাওয়ার অধিকার সবারই আছে।
আমার যখন মনে হবে আমি তোমার সাথে ভাল নেই। হয়তো ভবিষ্যতেও ভালো থাকবো না। আমি অবশ্যই চাইবো সম্মানজনকভাবে তোমার সাথে আমার দূরত্বটা বাড়িয়ে নিতে। আমাকে জোর করে আটকে রাখার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে??
যারা বলেন বদরুল খাদিজাকে ভালোবাসতো, বদরুল প্রতারণার শিকার। তাদের বলি ভালোবাসার মানেটা আগে ভালো করে বোঝেন। ভালোবাসা কখনো নৃশংস হতে শেখায় না, ভালোবাসা প্রতিনিয়ত আরো ভালবাসতে শেখায়। ভালোবাসা হলো তোমার মাঝেই আমার পূর্ণতা, তোমাতেই আমি জীবনভর বেঁচে থাকি।
রবিঠাকুরের গানের লাইনগুলো খুব মন দিয়ে শুনবেন………
তুমি সুখও যদি নাহি পাও, যাও সুখেরও সন্ধানে যাও–
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে, আরও কিছু নাহি চাই গো ॥
আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীনও, তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিবসও, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষও মাস ।
যদি আরও কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো ॥
হ্যাঁ, ভালোবাসা হল সেলফ-স্যাক্রিফাইস। ভালোবাসা প্রতিনিয়ত অনুভব করতে হয় হৃদয়ে, মননে।।
এখন কথা হচ্ছে পুরুষের মানসিকতার বদল হয়তো বছরের পর বছর মেয়েদের উপর চলা এই নৃশংসতা রোধ করতে পারে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে প্রতিনিয়ত নৃশংসতার পরিমাণ বাড়ছে। না পুরুষের মানসিকতার বদল হয়, না মেয়েদের উপর নির্যাতন কমে।
এখন বাকি রইলো দেশের প্রচলিত আইন ব্যবস্থা। কিন্তু তার উপরই বা আমরা কতটুকু আস্থা রাখতে পারছি? আইনের সঠিক আর কঠোর প্রদক্ষেপ থাকলে হয়তো অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব হতো।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের সরকার আছে, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, আছে বিচার ব্যবস্থা। আমাদের সবই আছে। তবু কেন আমরা আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না?
কারণ হচ্ছে এর প্রয়োগ, এর প্রয়োগ এতোটাই দুর্বল যে অপরাধ করতে চাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে বিচার ও শাস্তির ভয় নেই। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন injustice anywhere is a threat to justice everywhere. এবং প্রতিনিয়ত আমরা বোধহয় সেই হুমকিই বয়ে চলছি। জানি না এর শেষ কোথায়, তবু শ্রদ্ধেয় আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের বলা কথাটাই বলছি, হয়তো একদিন সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, আর এই নির্মম নিষ্ঠুরতারও অবসান হবে।