সাদিয়া রহমান: দেশের বেশ নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করে বেকার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গায়ে শিক্ষিত তকমা লাগানোর সময় চলে এসেছে। কিন্তু ভেতরে শিক্ষিত হতে পারা গেছে কতটুকু?
যেই পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বিগত চার বছর পার করেছি, তাতে কিছুদিন পর নিজেকে শিক্ষিত মনে হওয়ার বদলে মানসিক দিক থেকে পাকাপাকি পঙ্গু মনে হতে পারে। কারণগুলো দেখাই –
ঘটনা ১– যখন প্রথম ইংরেজী সাহিত্যে ভর্তি হতে গেলাম তখন আমার পিতাশ্রী ছিলেন সাথে। প্রশাসন ভবন থেকে শুরু করে সব জায়গায় আংকেলরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক কথা বলেছিলেন, “ইংরেজী অনেক কঠিন সাবজেক্ট তো, মেয়েরা সাধারণত পড়ে না এতে”। এই কথা বহুদিন, বার বার শুনেছি।

অতীতে শ্রেণীতে প্রথমদিকের স্থানগুলো ভাইয়ারাই দখল করে রাখতেন, কিন্তু এখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ উলটো। সংখ্যায় এবং ফলাফলে মেয়েরা রাজত্ব কায়েম করেছে। এখন সহপাঠী এবং সহপাঠিনীদেরও মুখে মুখে গুঞ্জন “ইংরেজী সারাদিন বসে বসে পড়া, বহুত ধৈর্য্য লাগে, এতে মেয়ে মানুষই ভালো করে”।
হুট করে কঠিন সাবজেক্টে পড়ার মতন কাজটা, এমনকি ধৈর্য্য রাখার ব্যাপারটাও নাক সিটকানোর হয়ে যায়! যেন পড়ালেখা না করে কত বিশাল/মহৎ রাজকার্য সম্পাদন করেন আমাদের “অন্য” ভাগেরা! এক বান্ধবী একবার মজা করে বলেছিলো যে, যেসব ছেলে ভালো রেজাল্ট করে, তারা তো পড়ে নারে, স্বপ্নে পায় প্রশ্নের উত্তরগুলো।
কদিন আগে ডেইলি স্টারের এক আর্টিকেলে দেখলাম সায়েন্সে পড়ার ক্ষেত্রে মেয়েরাই এগিয়ে, কিন্তু পাচ্ছে না সেরকম পর্যাপ্ত স্বীকৃতি। একবার এক মেডিকেলে পড়া বান্ধবীর আক্ষেপ শুনেছিলাম। মেয়ে শুনলেই মানুষ বলে “মেয়ে মানুষ গাইনির ডাক্তার হবা, আর কীইবা হবা”।
অর্থাৎ শান্তি, স্বাধীনতা, আনন্দ নাই কোথাও। বিভাগ, বিষয়, ক্ষেত্র যাই হোক এই ধরনের বৈষম্যের শিকার কমবেশি সব মেয়েই রোজ হয়ে থাকে।
ঘটনা ২- সেই ২০১৩ সালের কথা। শুকনো মুখে ক্ষিদা পেটে কোচিং-টিউশনির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকার কী মারাত্মক সব দিন! শহরের নামকরা কোচিং সেন্টার আর দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং এ যেয়ে ভরাট অহমিকা জড়ানো কন্ঠে শুনেছি, “আমরা মেয়ে টিচার নেই না”।
“কেন নেন না?” এর কোনো যৌক্তিক উত্তর কোথাও পাইনি। হিসাব মিলতো না। আমাদের গুরুজনদের তো দেখেছি, মেয়ে মাত্রেই টিচার বানিয়ে দিতে। মেডিকেল, এছাড়া খুব বেশি হলে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট এ না পড়ে যেইখানে যেই বিষয়েই পড়ুক, চোখ বন্ধ করে বলে দেই “মেয়ে মানুষ টিচার হবে, আর কী হবে!”। তাহলে ওইসব সময়ে আবার মেয়েরা টিচার হয় কীভাবে?
এমনকি হাইস্কুলের কোনো একটা ইংরেজী বইতে টেক্সটও আছে এই মর্মে যে, কেন টিচিং প্রফেশনটাই মেয়েদের জন্য সবচে উপযুক্ত। যতদূর খোঁজ নিয়েছি ওইসব কোচিংগুলোতে দৃশ্যপট কিছুটা বদলেছে। এখনো কোনো কোনো অভিভাবক ফোন করে অনেক গর্ব করে বলেন, “আমার ছেলে/মেয়ের জন্য টিচার লাগবে। “ছেলে”ই লাগবে, আমরা মেয়ে টিচার নেই না”। গলা যতো সম্ভব শান্ত রেখে বলি, “মাফ করবেন, আপনাকে সাহায্য করার সামর্থ্য আমার নেই”।
ঘটনা ৩- এবার আসি টেক্সট বই প্রসঙ্গে। ক্লাস এইটের এক স্টুডেন্টকে একবার পড়াতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম প্যারাগ্রাফ Street Hawker এর কিছু অংশ “He does not come when housemasters are at home. Rather he comes when housemasters are out of home and women are free from their household works and duties”। বোর্ড অনুমোদিত বই যখন শিখিয়ে দেয় পুরুষেরা হলো বাড়ির কর্তা, আর মেয়েদের কাজ কেবল বাড়ির ভেতরে তখন আমাদের ছেলেমেয়েরা কী শিখবে বলে আমরা আশা করি?
এই প্যারাগ্রাফে স্ট্রিট হকারকে “কানিং” ও বলা হয়েছিলো। সেটা আরেক রকমের ভিন্ন প্রসংগ। কদিন আগে ক্লাস নাইনের এক স্টুডেন্টকে পড়াতে যেয়ে একটা বাক্য নিজেই খেয়াল করিনি। লাইনগুলো এরকম “The cowboy needed food. So he took a wife to cook meals. বাচ্চাটা হুট করে বলে উঠেছে, “আপু এই প্যাসেজটা আমার একদম পছন্দ না। এমনভাবে লিখেছে মেয়েদের একমাত্র প্রয়োজন বেবি দেয়া আর একমাত্র কাজ রান্না করা”।
হঠাৎ করে কেমন ধাক্কা মতন লাগলো। কেমনভাবে মিলে জুলে গেছি যে একটুও গায়ে লাগেনি! লাগে না গায়ে, বুঝিও না আমরা আর। কিন্তু কিছু কিছু বাচ্চার গায়ে লাগে। বাকীরা কেউ সেটা পরিণতি, কেউবা সেটাকেই স্বাভাবিক জেনে বড় হয়। একেই বুঝি বলে স্লো পয়জনিং। আমাদের কারো কিছু করার নাই।
ঘটনা ৪- বান্ধবীর বিয়ে। টোটাল এরেঞ্জড ম্যারেজ। ছেলেপক্ষ থেকেই প্রস্তাব আসা। দুটোই সম্মানিত পরিবার। এক বন্ধুর প্রশ্ন, “ভাইয়া কী করে?” “ইঞ্জিনিয়ার”… “ও! ইঞ্জিনিয়ার পেয়ে খায়া দিসো, বুঝি বুঝি..” ধরলাম এটা মজা। মজাটা ভিন্ন রকমের হতে পারতো। মজাই যদি হয়, তাহলে তো এমনও হতে পারতো, “ভাইয়া সুন্দরী মেয়ে দেখে আটকে গেছে”। যদিও বুঝি না যে, মজা করার জন্য কেউ কেনো কাউকে খায়া দিতে হবে! বুঝি না সব হিউমার, সব সারকাজম, সব ফান কেন মেয়েদের নিয়ে বিকৃত ইংগিত না করা পর্যন্ত পূর্ণ হবে না।
ভুল বললাম। আগে বুঝতাম না। এখন বুঝি।
ওই যে ওই টেক্সট বইগুলো যারা পড়ে, সত্য জেনে বড় হয় তারা কেমন হয় সেসবেরও চাক্ষুষ প্রমাণ এরা দিয়ে দেয়। এরাই বড় হয়ে মেয়ে হয়ে মেয়েদের ছোট করে। ছেলে হয়ে “খায়া দে” টাইপের মারাত্মক থিওরি বের করে। এরাই নব্য প্রেমে পড়া প্রেমিককে বলে “মাম্মা খায়া দে”; আর প্রেমিকাকে এসে ভুরু নাচিয়ে বলে “হু হু, ভালো গাছে দড়ি বাধসো”। কখনো উত্তর দিয়ে, কখনো নীরবে সরে যেতে হয়।
আমাদের বলার কোনো কথা নেই। আমাদের বলার কোনো জায়গা নেই। আমাদের দুদণ্ড শান্তিতে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার আনন্দটাও নেই। নিজের মাঝে নিঃশেষ হতে থাকা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এক এক সময় মনে হতো ছোটো শহর বলে এমন হয় কি? পরে জেনেছি কী ছোটো, কী বড়, সবখানেই অবস্থা একই। বেশি বৈ তো কম না। উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে পড়তে এসে অনেক ক্ষেত্রে মানসিক পঙ্গুত্ব নিয়ে বের হয়ে যেতে হয়। এর শেষ কবে কোথায় জানা নাই।