বাচ্চা আবার “জারজ” হয় কীভাবে?

মারজিয়া প্রভা: আমাদের পথের ইশকুল নামে একটি ইশকুল আছে পথশিশুদের জন্য। এই স্কুলে গুণে গুণে ৩০ জন বাবু আছে। বয়স তিন থেকে বয়স এগারো অবধি। গুলিস্তান পার্কে এদের কেউ ভিক্ষা করে, ছোলা বিক্রি করে, গাঁজা বিক্রি করে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, এই বাবুগুলোর অনেকেই ডান্ডিখোর ছিল। ছোট্ট মেয়েদের অনেকেই চাইল্ড প্রস্টিটিউশনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। এদেরকে একটু একটু করে টেনে আনছি আলোর দিকে। আমাদের পথের স্কুলের অর্গানাইজার মাটি ভাই আর তারেক ভাই দিনমান এদের পাশে থাকে। মোটিভেট করে, নতুন জীবনের আশা দেখায়।

এদের অনেকের মা বাবা কেউ নেই। কিংবা বাবা জেলে, কিংবা বাবা মা থাকলেও খোঁজ নেই। বিজয় নামের এক মেধাবী ছেলে আমাদের স্কুলের ছাত্র। ওর মা নার্গিস খালাই এই স্কুল তৈরির পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। বাচ্চাদের ধরে ধরে আমাদের স্কুলে বসিয়ে দিতেন উনি। নার্গিস খালার পেটে যখন বিজয়, তখন বিজয়সমেত নার্গিস খালাকে রেখে বিজয়ের স্পার্ম ডোনার পিতা পগার পার হয়েছে। সেই থেকে নার্গিস খালা গুলিস্তান পার্কে ছিল। বছর দুয়েক আগে বিজয়ের নতুন বাবাকে বিয়ে করেন নার্গিস খালা।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি নার্গিস খালা আমাদের ছেড়ে চলে যান। পুরো শরীর তার পচে যায় গ্যাংগ্রিনে। মৃত্যুর আগে তার আকুল আবেদন ছিল, বিজয়কে যেন কোনো একটা আবাসিক স্কুলে দেই আমরা। যেই ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার বিজয়ের মা পায়নি, তা যেন আমরা দেই বিজয়কে।

নার্গিস খালার পচে যাওয়া শরীর দাফনের আগে কেউ গোসল দিতে চায়নি। আমরা টাকার জোরে গোসল দেওয়ালাম। আমরা নিজেরাও ছোট চাকরির জমানো টাকা শেষ করেছি নার্গিস খালাকে বাঁচাতে। পারলাম না। তাই বলে কি বিজয় সুন্দর জীবন পাবে না!  শুরু হলো আমাদের ফেসবুক ইভেন্ট ‘বিজয় যাবে স্কুলে’ (ইভেন্ট লিংক: https://www.facebook.com/events/660807030792951/) । স্বপ্ন দেখি মার্চের এক তারিখেই বিজয়ের স্কুল যাওয়ার। কিন্তু তথাকথিত এলিট সোসাইটির বাচ্চারা যেসব আবাসিক স্কুলে পড়ে এবং থাকে, সেই স্কুলগুলো নিতে চাচ্ছে না বিজয়কে। এর একটি নিতে চাইলেও, যে টাকার এমাউন্ট ধরিয়ে দিয়েছে তাতে আমরা হতভম্ব।  

অবশেষে নবারুণ স্কুল আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রাবাড়ীর এই স্কুল ১০,০০০ টাকা চেয়েছে প্রথম মাসের বেতন, ভর্তির খরচ, হোস্টেল ফি এর জন্য। বই খাতা, জামা কাপড়, স্কুল ব্যাগ, জুতা সব কিনতে আরও লেগে যাবে প্রায় ৬০০০ টাকা। মোট ১৬০০০ টাকা টার্গেট।

তো ওমানে অবস্থিত আমাদের এক শুভাকাঙ্ক্ষী ভাই ওদেশের এক বাংলাদেশী ভাইদের সংগঠনে উঠিয়েছিল আমাদের বিজয়ের কথা। ঐ ভাইটা বিভিন্ন সময় দেশের গরীব ছাত্রদের টাকা দেয়। বিজয়ের কথা শুনে এক বড় ভাইয়ের উক্তি ছিল এমন, “বিজয়দের পড়াশুনা করে লাভ কী? এরা তো জারজ সন্তান”।

ঢাকার আবাসিক স্কুলগুলো পিছিয়ে গিয়েছিল এই এক কারণে, কারণ বিজয়ের আসল বাপের পরিচয় নেই। মা মারা গিয়েছে। অভিভাবক নতুন বাবা। পুরো ঘটনা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও মনে উঁকি দেয়, বিজয় ‘জারজ বাচ্চা’।

জারজ কী? বাবার পরিচয় নেই? মা এর পরিচয় তো ছিল। নার্গিস খালা নিজের জীবনের সবটুকু দিয়ে মানুষ করেছে বিজয়কে। কোথায় ছিল তার সেই স্পার্ম ডোনার পিতা তখন? কোথায় ছিল সে বিজয় যখন ডান্ডির নেশাতে ডুবে যাচ্ছিল? সেই পিতার জন্য আজকে তাকে শুনতে হবে জারজ বাচ্চা? বাচ্চা আবার জারজ হয় কী করে?

বাচ্চার জন্মতে তো বাচ্চার নিজের হাত থাকে না। তাহলে তাকে কেন সারা জীবনময় এই নোংরা কথা শুনে যেতে হবে? কেন তার গায়ের সঙ্গে ট্যাগ লাগানো থাকবে ‘জারজ’ ?

আমাদের এলিট সোসাইটি বিজয়কে একটুও জায়গা করে দিবে না। বিজয়কেই জায়গা করে নিতে হবে। এই সোসাইটি বিজয়কে কেবল জারজ বলেই কেটে পড়বে! কখনো নিজেদের বাচ্চার স্কুলের পাশে ফ্রিতে জায়গা দিবে না।

চিলির মাচুকা মুভিতে এমনই এক গল্প ছিল। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রধান শিক্ষক যখন গরীবের ছেলে মাচুকাকে বড়লোকদের স্কুলে ফ্রিতে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন, তখন এলিট পাবলিকরা এর জোর বিরোধিতা করে। একসময় চিলির সমাজতন্ত্র ভেংগে গেলে মাচুকাদের বেরিয়ে যেতে হয়।

অথচ বিজয়ের এই দুঃসহ জীবনের দায় কি আমাদেরও না? এই বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া সব বাচ্চাদের কি সমান অধিকার দেবার কথা ছিল না?

বিজয়কে মার্চের এক তারিখে নতুন স্কুলে ভর্তি করাবো। জারজ বাচ্চার পরিচয়ে নয়, বিজয় বাঁচবে নিজের পরিচয়েই। এই এলিট সোসাইটির সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে। সেই স্বপ্নে বিভোর। প্রায় ৭০০০ টাকা উঠে গেছে। বাকি আরও ৯০০০ টাকা। আমাদের পাশে দাঁড়াতে চাইলে, বিজয়ের অভিভাবক হতে চাইলে ৫০ টাকা বিকাশ করুন

প্রভা 01798753500 (পার্সোনাল)

মাটি 01842022266 (পার্সোনাল)

তারেক 01815225923  (পার্সোনাল)

বিজয়ের প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো খরচ হবে আবাসিক স্কুলে। রেগুলার ডোনার হতে চাইলেও আমাদের সঙ্গে থাকুন। আপনার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় নতুন এক আলোর সূচনা ঘটবে। পৃথিবীতে কোন বাচ্চাই যে “জারজ” না তা পৃথিবী বুঝবে। সব বাচ্চারই সমান ভাবে জীবন যাপনের অধিকার আছে, তা বুঝবে।

এটা বোঝানোর সময় এখনোই। আমার এবং আপনার। সবার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.