শিল্পী জলি: প্রতিবেশী ফ্লোরা ছিল আমাদের নাটের গুরু। দুনিয়ার বুদ্ধি তার মাথায় গিজ গিজ করতো। বৃষ্টি হতেই সে আমাদের বলতো কচু পাতার পানি সংগ্রহ করতে। কচু পাতার পানির খোঁজে দিকবিদ্বিক ছুটতাম আমরা– কে কত পানি সংগ্রহ করে কার আগে মাথায় দিতে পারি।
তার মতে, কচু পাতার পানি মাথায় দিলে স্ব- চক্ষে সাপের মাথার মণি দেখা যায়। মাথায় পানি দিতে দিতে নিমিষেই কাকভেজা হয়ে যেতাম আমরা, কিন্তু সাপ আর দেখা দিত না। তবুও চেষ্টা অব্যাহত থাকতো– নিশ্চয়ই পরের বার দেখা দেবে এই ভেবে।

বড় বেশী ফ্যাশন করতো ফ্লোরা, বিশেষ করে চুলের। আবার ঢঙেও ছিল পাড়ার সেরা। বসবাস রাজবাড়ীতে হলেও নানিবাড়ি ছিল ফরিদপুরে। তাই ঘন ঘন রাজবাড়ী-ফরিদপুর আসা-যাওয়া চলতো তার। ফরিদপুরে এলেই সে ওদের রাজবাড়ীর গল্প শোনাতো– ওখানকার ছেলেমেয়েরা কেমন ডাটের, কেমন করে চোখে চোখ রেখে কথা বলে, কেমন কাজল টানা ভেজা ভেজা চোখ তাদের, আমাদের ফরিদপুরীদের মতো মেন্দা নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিকেল হতেই সে সেজেগুজে আসতো। আমরা সবাই মিলে যেতাম পাঁচির মায়ের রান্না দেখতে, এলাকার গাছি শুকুর মিঞার স্ত্রী। পাঁচির মা রান্না করতো আর ফ্লোরা পরামর্শ দিতো–এটা দিতে হবে, ওটা দিতে হবে….। একবার পাঁচির মায়ের কোলের বাচ্চার জন্যে আটা ঘুটা রান্না দেখে ফ্লোরা বললো, চল আমরা সবাই মিলে আটা ঘুটা রান্না করি–খেতে খুবই মজা। বাসা থেকে সবাই হাতের এক মুঠ করে আটা চুরি করলাম, সাথে লবন, চিনি, এবং পাতিল। মাটি খুঁড়ে ইট বিছিয়ে বানানো হলো চূলা। অতঃপর গাছের নিচের পাতা কুড়িয়ে চিনি লবণ দিয়ে ধোঁয়া-ছাই মিলিয়ে রান্না হলো আটাঘুটা।
মুখে দিতেই ‘ওয়াক্ থু’– পটু কাল্লাহে তালার গন্ধ (ধোঁয়ায়), খাওয়ার উপায় নেই। সব পরিশ্রম মাঠে। তবুও মুখে কিছু বলি না– মাথা নাড়াই, ভালো ভালো। বাই দ্য ওয়ে, আমেরিকায় জনসম্মুখ এক্সিডেন্টাল পুটুমে ‘excuse me’ বলার নিয়ম।
বোন ঢাবি থেকে বাড়িতে আসতেই ফ্লোরাসহ পাড়ার সখীরা ছুটে আসতো আমাদের বাসায়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বাস করে বোনের কী পরিবর্তন হয়েছে তা দেখতে। আমরা মনে মনে দোয়া করতাম, বোন যেন এবার তেমন কোনো ভাব না দেখায়। চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করতো তারা। বোন যেখানে যায়, পিছু পিছু যেত–যতক্ষণ না কোন বিশেষ ভাব সনাক্ত হয়। শঙ্কা বাড়তো আমাদের (আমি আর আমার পিচ্চি বোনের), কিন্তু কাউকেই কিছু বলতে পারতাম না।
একবার তারা বললো, ‘তোর আপা ডাট দেখিয়ে বলেছে–মামণি, মামণি, ধরনী দাওনি কেন, আমিতো পড়ে যাবো।’
সনাক্তকৃত ডাট, সে নাকি ‘মা’কে ‘মামণি’ বলেছে এবার।
এসব খুঁটিনাটি চাপাচাপি থাকলেও মাঝে মাঝেই আমরা হাতের বুড়া আঙ্গুলে আঙ্গুলে ছুঁয়ে বন্ধুত্ব পাতাতাম। বন্ধুত্ব রক্ষার শর্ত বিপদে-আপদে সাথে থাকা আর বাড়িতে তৈরিকৃত সব ভালো খাবারের ভাগ দেয়া। বন্ধুত্ব পাতাতেই শুরু হতো কার বাসায় কী রান্না হচ্ছে তার খোঁজ রাখা। বিশেষ করে মাছ, মাংস, পিঠা, ফল, মিষ্টি, পায়েস…। সকাল-দুপুর-বিকেল বেলা খেতে বসতেই করতে হতো চুরির ধান্দা। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে খাবার চুরি করে পকেট ভরতাম। সারাদিন চিন্তা থাকতো কীভাবে পরের বেলায় চুরি হবে।
এই ভয়াবহ চাপে বন্ধুত্ব বেশীদিন টিকতো না। ঝগড়া বেঁধে যেতো যখন-তখন। শুরু হয়ে যেত কে, কোনদিন, কার, কোন খাবার ছোঁচার মতো চেয়ে খেয়েছিল তার খোঁটা দেয়াদেয়ি। অতঃপর কেনি আঙ্গুল দিয়ে আড়ি। আর আড়ি হতেই মারামারি। একা পেলেই ফ্লোরা-মিলারা আর আমি এবং আমার ছোটবোন মারামারি শুরু করে দিতাম।
ওরা না পারলেই উচ্চ স্বরে ডাকতো–গাপ্পু মামা !
হুঙ্কার দিয়ে গাপ্পু মামা ছুটে আসতো আমাদের মারতে। অমনি আমরা দৌড়ে পালাতাম।
গাপ্পু মামা আমাদেরই বান্ধবী, রুমা। পাড়ার মধ্যে ঐ সময়ের নামকরা সুন্দরী– ইয়া লম্বা এবং শক্তিও ছিল বেশ। ক্ষণে ক্ষণে মারামারি আর ঝগড়ার চাপে আমাদের আড়িও বেশিদিন টিকতো না। ক’দিন যেতেই কোন এক মধ্যপন্থির সহায়তায় ‘ভাঙবো না, ভাঙবো না’ করে বুড়া আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে লাজুক হাসিতে আড়ি ভেঙে নিতাম। আড়ি ভাঙতেই ভাব হতো দ্বিগুণ, আবার বন্ধু পাতানো, খাবার চুরি, আবার টেনশন, মারামারি…..।
বয়স পনের/ষোল হতেই প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া-ছ্যাকা, ভূত-ভবিষ্যত, সফলতা- ব্যর্থতা এসে মানুষের জীবন বদলে দিতে থাকে। নানাবিধ চাহিদার চাপে একটু একটু করে জীবন থেকে সুখ হারাতে থাকে। অতঃপর জীবন শেষে প্রকৃত সুখের খোঁজ কিশোর বেলাতেই খুঁজে পাওয়া যায়l
যেখানে কোন চাওয়াই থাকে না সেখানে চাওয়া-পাওয়ার গড়মিল কিসের?