“উইমেন চ্যাপ্টার কি জ্যাকুলিন মিথিলাদের কাছে পৌঁছায়?”

আফরিন শরীফ বিথী: আজকাল আমাদের সমাজের মানুষগুলো কোনো ইস্যু নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবাটাকেও বোকামি মনে করে, আনস্মার্ট ভাবে, হাসাহাসি করে, আঁতলামি মনে করে। মানুষ আজকাল ভাঁড়ামি করতে, দেখতে এবং বিকৃত বিনোদন নিতেই বেশি পছন্দ করে। যে কারণে আমরা ফেসবুক, ইন্টারনেট, ইউটিউব, অনলাইন পোর্টালগুলোতে- দমফাটা হাসির ভিডিও, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে, একবার খুলেই দেখুন, এ কী করলো আবুল, কী সেই গোপন কাহিনী, ইত্যাদি প্ররোচনামূলক টাইপের লিংক দেখলেই ওপেন না করে পারি না।

বিশেষ করে এ সময়ের তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ এ ভাঁড়ামি রোগে আক্রান্ত। আসলে এই যান্ত্রিক জীবনে আমরা একটু প্রাণ খুলে হাসার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। তাই সামাজিক, সাহিত্য, ঐতিহাসিক, প্রগতিশীল ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়গুলোর চেয়ে ভাঁড়ামিটাকেই বেশি পছন্দ করি। মানুষকে হাসাতে পারাটাও সহজ কথা নয়। ব্রিলিয়ান্ট কনসেপ্ট ছাড়া ব্রিলিয়ান্টদের হাসানোও যায় না। তাই কৌতুক করাটাকে দোষের মনে করছি না। কারণ কৌতুকের মাধ্যমেও সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা যায়।

আফরিন শরীফ বিথী

কিন্তু একটা বিষয় খুব ভাবায়। এই যে আমরা যেকোনো সামাজিক অসঙ্গতি, অমানবিক, অনুচিত ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদী লেখা লিখছি, সেগুলো কী সেই ঘূণে ধরা মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায়, যাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোর জন্যই লিখছি?তাদের কজন পড়ে এসব লেখা? পড়লে তো একটু হলেও গতানুগতিক চিন্তায় ধাক্কা লাগে। কীভাবেই বা পৌঁছাবে আমরা যদি শুধু ভাঁড়ামি নিয়েই ব্যস্ত থাকি!

এই যে জ্যাকুলিন মিথিলা আত্মহত্যা করলো, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই কিন্তু মেয়েটার আত্মহত্যা করায় খুশিই হয়েছে। বাজে বাজে মন্তব্য করেছে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে। কিন্তু এই মেয়ে যখন ফেসবুকে বিকৃত বিনোদনের আসর জমাতো, তার ফলোয়াররা সেই বিনোদন নিতে একটুও দেরি করতো না। অথচ এই মেয়ে কেন এমন অসুস্থ পথ বেছে নিল, কেনই বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলো, কী সেসব সামাজিক, মানসিক কারণ, এসব নিয়ে কিন্তু কেউ ভাবে না। যেকোনো সামাজিক অপরাধের অন্তর্নিহিত কারণগুলো নিয়ে যারা ভাবে, লিখে সেসব আমরা এড়িয়ে যাই!

উইমেন চ্যাপ্টার কি জ্যাকুলিন মিথিলা পর্যন্ত পৌঁছেছিল? সে কি উইমেন চ্যাপ্টারের মতো আত্মবিশ্বাস জাগানীয়া প্রেরণামূলক মাধ্যমগুলো সম্পর্কে জানতো? সম্ভবত না! জানলে হয়তো সে আত্মবিশ্বাস পেত, তার মানসিক সুস্থ্তা আসতো, ওসব ছেড়ে সম্মানের পথ বেছে নিত, আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্তও হয়তো তাকে নিতে হতো না।

সমাজ চায় মানসিক অসুস্থতার মিথিলারা মরেই যাক। কিন্তু মিথিলাদের চেয়ে বেশি অসুস্থ যে এ সমাজ, সেটা সমাজ বুঝতে পারে না। আমরাই সমাজ। তাই সামাজিক অসুস্থতা সারিয়ে মিথিলাদের সুস্থ রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। বিকৃত বিনোদনের খোরাক দেয়ার মতো আরও মিথিলা আমাদের সমাজে আছে।

কৌতুহূলের বশে আমি দেখেছি সেসব মিথিলাদের সেলিব্রিটি হওয়ার জন্য বিকৃত পন্থা অবলম্বন করতে। একজন মানুষ হিসেবে ওগুলোকে স্বাভাবিক ভাবতে পারিনি আমি। তাদের সুস্থ পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বটা আমাদেরই। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে অনুরোধ করা। আমরা মজা করা, কৌতুক করা, বিনোদন নেয়ার পাশাপাশি যেন সমাজটাকে বদলাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দেই, যেন যেকোনো কল্যাণকর ম্যাসেজ নিজেও নেই এবং অন্যের কাছেও পৌঁছে দেই।

এটুকু দায়িত্ববোধেই হয়তো সমাজটা একদিন বদলে যাবে আপনার হাত ধরেই। অনেকে বলে ফেসবুক, ইন্টারনেটে এসব লিখে কী হবে! লিখে যদি কিছু নাই হয় তাহলে কেন আমরা সমুদ্রের তীরে পড়ে থাকা শিশু আয়লানের লাশ দেখে কেঁদে ফেলি, কেন শরীরে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে তনুর ক্ষতবিক্ষত ধর্ষিত লাশ দেখে, কেন পুজার ধর্ষকের শাস্তিতে সোচ্চার হয়ে উঠি?

কারণ আমাদের মানবিক চেতনায় ধাক্কা লাগে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা এসব নিষ্ঠুর চিত্রের পিছনের কারণ নিয়ে ভাবি, প্রতিবাদী হয়ে উঠি। ঠিক তেমনি লেখা পড়েও মানুষ নতুন করে ভাবতে শিখে। তাই লিখতে হবেই, আর সেই লেখা পৌঁছে দিতে হবে তাদের কাছে যাদের উদ্দেশ্যে লিখি।

আমি বিশ্বাস করি মানুষের মধ্যে যদি ঔচিত্যবোধটা জাগানো যায় তাহলে সে নতুন করে ভাবতে শিখে। এই বোধ জাগানো যেতে পারে যেকোনো মাধ্যমে। আমার কাছে মনে হয় লেখাই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম।

তাই লেখার মাধ্যমে সেই সব জং ধরা অসার মস্তিষ্কে চেতনা জাগাতে হবে, যারা মস্তিষ্ক চর্চার সুযোগ পায়নি সমাজের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই। আরেকটা কথা না বলে পারছি না। আমরা কিন্তু সাহিত্য বিচারে কার লেখা কতটা ভালো হলো সেই হিসেব করে লিখি না। যারা ইতোমধ্যে গতানুগতিক, সামাজিক, মানসিক জরাজীর্ণ হতে মুক্ত, তাদের উদ্দেশ্যেও লিখি না।

লিখি তাদের উদ্দেশ্যেই যাদের জরাজীর্ণ মানসিকতার জন্যই আমাদের লিখতে হচ্ছে। এতো ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে কষ্ট করে লিখি শুধু সেসব মানুষের বোধ জাগাতে, সমাজটাকে সুন্দর দেখতে। আমরা কবি, সাহিত্যিক খেতাব পেতেও লিখি না। লিখি এ সমাজের জন্য, এ পৃথিবীর জন্য, আমাদের সুস্থ মানসিকতার জন্য। ক্ষয় হউক অসুস্থ চিন্তার, ছড়িয়ে পড়ুক সুস্থ চেতনা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.