অনীলা পারভীন: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ ভাষা শহীদের আত্মত্যাগের ফলে আজ আমরা আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলছি৷ সেই সব ভাষা শহীদদের জন্য রইল গভীর শ্রদ্ধা৷
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘একসময় বাংলাদেশ হবে বাংলা ভাষার রাজধানী‘৷ উনি আজকের বাংলাদেশ দেখলে হয়তো তার মন্তব্য কিছুটা বদলে ফেলতেন৷ কেনো বলছি একথা? আসুন সেই প্রসঙ্গে যাই…

বিদেশে থাকে অধিকাংশ বাবা–মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা শেখানো নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেন৷ কিছু বাবা–মা এ ব্যাপারে উদাসীন, তাদের প্রসঙ্গ আর নাই টানলাম৷
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রবিবার সিডনিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো বইমেলা। মেলাতে ‘ইকরিমিকরি‘ প্রকাশনার শিশুদের বই নিয়ে স্টল দিয়েছিলাম৷ তাতে আমার অভিনব সব অভিজ্ঞতা হলো৷ বাবা–মায়েরা, এমনকি শিশুরা নিজ আগ্রহে বাংলা বই নিয়ে গেল৷ আরও যেটা ভালো লাগা তৈরি করল, তা হলো, অনেকেই আমাদের কাছে ‘আদর্শলিপি‘ চাইলো এবং না পেয়ে বললো, আমরা যেন সেটা আনাই৷
আমি খুবই অবাক হলাম৷ কারণ আমার জানা মতে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাও এখন আদর্শলিপি পড়ে না৷ তাদের এই আগ্রহ আমার মধ্যে সুখানুভুতি দিলো৷ যে সব বাবা–মা সত্যিকারভাবেই চেষ্টা করেছেন, তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখছে, শুদ্ধভাবেই বাংলা বলছে৷ এমন বেশ কিছু পরিবার আমরা চিনি৷ এক মেয়ে, এদেশে জন্ম ও বড় হওয়া, তার কাছ থেকে শুনেছি– ও দেশে গিয়ে ওর মামাতো/ফুফাতো ভাই–বোনদের সাথে যখন বাংলায় কথা বলে তখন তাদের কাছ থেকে উত্তর পায় ইংরেজিতে৷ বাহ্! কী চমৎকার!
এবার প্রসঙ্গ চলেই আসে দেশে বাংলা চর্চা৷ একটা সময় ছিল ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েদের আমরা কড়া ভাষায় সমালোচনা করতাম- বাংলা সঠিকভাবে বলতে পারেনা বা কথায় ইংরেজির অতি ব্যবহার, সেজন্য৷ এই সমস্যা তো দূর হয়ইনি বরং বর্তমানে যোগ হয়েছে আরবি ভাষার ব্যবহার৷ আজকাল অনেকেই কিছু আরবি শব্দ বাংলার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে৷ তাদের যুক্তি, সেটাই নাকি সঠিকভাবে অনুভূতি ব্যক্ত করা হয়৷ আমরা জানি, বাংলা ভাষায় কিছু ইংরেজি শব্দ আছে যা এমনভাবে বাংলার সাথে মিশে আছে সেটা যে ইংরেজি তাই আমরা ভুলে যাই বা অনেকে জানিই না৷ যেমন চেয়ার, টেবিল, টেলিফোন, টেলিভিশন ইত্যাদি৷ আমরা অনেকেই জানিনা ওগুলির বাংলা- কেদারা, মেজ, দূরালাপনি, দূরদর্শন৷
তেমনি কিছু আরবি শব্দও আমাদের ভাষায় যুগ যুগ ধরে মিশে আছে৷ যেমন মাশাল্লাহ, ইনশাল্লাহ৷ যখন আমরা চেষ্টা করছি বাংলা ভাষাকে আরো কত সমৃদ্ধ করা যায়, কীভাবে বাংলার সাথে ইংরেজি না মিশিয়ে কথা বলা, তখন কিনা গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো আরবি এসে চেপে বসছে৷
আমি আগেই বললাম, যেসব শব্দ মিশে গেছে সেগুলি দূর করা যাবে না, কিন্তু নতুন শব্দের ব্যবহার এতোখানি জরুরি কেন হয়ে পড়লো, সেটা আমার বোধগম্য হয় না৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাকারাল্লা খায়ের৷ ধন্যবাদ শব্দটা এতো কী দোষ করলো যে আমাকে ওরকম একটা খটমটে শব্দ বলতে হবে!
আমরা আসলে জাতি হিসেবে ছোট জাতের তাই তো অন্যেরটা গ্রহণে আমাদের এতো আগ্রহ৷
তাই তো আফ্রিদিরা আমাদের দেশে সংবাদ সম্মেলনে উর্দুতে কথা বলার দু:সাহস পায়৷ সাকিবকে হিন্দিতে প্রশ্ন করার আস্পর্ধা দেখায় ভারতীয় সাংবাদিকরা৷ সেটাও আমাদেরই দোষ৷ কারণ ভারতীয়, পাকি দেখলেই আমরা ওদের সাথে ওদের ভাষায় কথা বলা শুরু করি৷
আমি বহুবার বহুজনকে বলতে বাধ্য হয়েছি, ‘আমি তোমাদের ভাষাটা জানি না, দয়া করে ইংলিশে বলো‘৷ এ প্রসঙ্গে অনেকেই জিজ্ঞেস করবে, তাহলে ইংলিশে কথা বলছি কেনো?
প্রশ্ন যে করবে উত্তর তারও জানা আছে, তবুও তর্কের খাতিরে তর্ক করবে৷ আরেকটা দেশের ভাষা জানা অবশ্যই গর্বের ব্যাপার৷ এটা একধরনের পারদর্শিতা৷ কিন্তু ব্যাপারটা যখন দাঁড়ায় এমন যে, ওর ভাষা আমাকে জানতেই হবে, কিন্তু আমার ভাষা জানা ওর জন্য জরুরি না, সমস্যাটা সেখানেই হয়৷
এ আমাদেরই দৈন্য৷ আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে কোনোদিনও আমাদের এই দৈন্যদশা কাটবে না৷
আমরা যারা প্রবাসী, তারা কয়জন আমাদের বিদেশী বন্ধু, প্রতিবেশী বা সহকর্মীকে একুশের এই মহান দিনটা সম্মন্ধে অবগত করি৷ যদি না করি তাহলে ওরা জানবে কি করে যে আমাদের গর্বের জায়গা আছে? পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল৷ আমাদের কতজন বাবা–মা, ছেলেমেয়েদেরকে দেশের ইতিহাসটা শোনাচ্ছেন? সময় শেষ হয়ে যায়নি৷ নিজে সচেতন হন, আপনার শিশুকে সচেতন করুন৷ আমাদের গর্বের এমন স্থানটুকু যেনো আমরা আগলে রাখি৷ শহীদদের রক্ত যেনো বৃথা না যায়৷
সরকারি কর্মকর্তা
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া