শামীম রুনা: বেশ কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়াতে আমেরিকান টিনএজার ড্যানিয়েলকে নিয়ে মাতামাতি চলছে। মিডিয়া বর্তমানে সিজনাল ড্যানিয়েল জ্বরে আক্রান্ত, ওর মুখে ব্যবহৃত বাক্য কোড করা হচ্ছে কথায় কথায়।
কিছুদিন আগে ড. ফিল তার টিভি শো’তে ড্যানিয়েল এবং তার মা মিজ্ বারবারা এনকে নিয়ে আসেন। ড. ফিল হলেন আমেরিকার একজন জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব, সাইকোলজিস্ট, স্যোসিওলজিস্ট ও লেখক। তিনি প্রথমে অপরা উইনফ্রে’র ডেইলি টক শো’তে হিউম্যান বিহেভিয়ার এক্সপার্ট হয়ে কাজ করতেন, পরে ২০০২ সাল থেকে ড. ফিল নামে টিভি শো’র হোস্ট হয়ে নিজে টকশো শুরু করেন, শো’টি সিবিএস চ্যানেলে দেখানো হয়। এই প্রোগ্রামে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
ড. ফিল মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেন নিজের সমস্যার কথা ও সমস্যার পেছনের কথা বলতে। জীবন ভিত্তিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার কারণে এখন তুমুল জনপ্রিয় ড. ফিল শো। মিজ্ বারবারা তার তেরো বছর বয়সী মেয়ে ড্যানিয়েলকে নিয়ে এই শো’তে হাজির হন, তার মেয়ে আউট অফ কন্ট্রোল, কোনো ভাবে তিনি মেয়েকে সামলাতে পারছেন না। কারণ…………
মেয়ে ড্যানিয়েল হাসতে হাসতে ড. ফিলকে বললো, ওদের মা-মেয়ের সম্পর্কটা এমন যে কখনও মা রাগ করে মেয়ের দরজা ভাঙে, কখনও বা মেয়ে মায়ের দরজা ভাঙে। ওদের বাড়ির কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়, মায়ের গেস্টের সামনে মা-মেয়ের প্রচণ্ড ঝগড়া, দুদ্দাড় করে দরজা বন্ধ করে দেয়া, হাউকাউ অবস্থা, মাঝে মাঝে ড্যানিয়েলের মুখের কথা মিউট করে দেয়া হচ্ছিল। এই ভিডিও ক্লিপ দেখে শো দেখতে আসা অডিয়েন্স হাত তালি দিল!
লাউডলি, বোল্ডলি এবং আমেরিকান স্ট্রিট ল্যাঙ্গুয়েজে ড্যানিয়েল কথা বলে। ড. ফিল যখন জানতে চাইলো, সে ক্লাস সেভেনে পড়ছে কিনা, উত্তরে মেয়েটি জানায়, ক্লাস ফাইভের পর সে আর স্কুল কন্টিনিউ করেনি এবং তা শুনেও অডিয়েন্স হাত তালি দেয়, এই পর্যায়ে মনে হতে পারে অডিয়েন্স হয়তো ওর সত্যবাদিতাকে এপ্রিসিয়েট করে হাত তালি দিয়েছে। ড্যানিয়েল ধুমপান করে এবং এই বয়সে গাড়ি চুরির অভিযোগে একবার জেলেও গিয়েছে। ওর মা বারবারা ড. ফিলকে বলে, ড্যানিয়েল অনেক গালাগাল করে। মায়ের কথা শুনে স্টেজে ড্যানিয়েল মায়ের দিকে তেড়ে গেলে ড. ফিল ওকে নিজের সিটে গিয়ে বসতে বলে। ড্যানিয়েল অডিয়েন্সকে “হোর” সম্বোধন করে বলে, Cash me outside how bow dah….। তখনও অডিয়েন্স হাত তালি পায়।
বিচিত্র উচ্চারণে বলা ড্যানিয়েলের এই বাক্যটি এখন মুখে মুখে। আর ড্যানিয়েল হয়ে গেছে রাতারাতি বিশাল সেলিব্রেটি। অবশ্য ড্যানিয়েলকে নিয়ে শো করার পর জনপ্রিয় ড. ফিল শো”র রেটিং আকাশ ছোঁয়া।
ড. ফিল শো’র কল্যাণে ড্যানিয়েলের ইনস্টাগ্রামে ৪.৮ মিলিয়ন ফলোয়ার আছে এবং তা প্রতিদিনই বাড়ছে। ওর একাউন্ট ভেরিফাইড। ওকে দিয়ে মিউজিক ভিডিও তৈরি করা হয়েছে এবং ও ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিওতে অংশ নিচ্ছে। ওর নামে একটি গেম লঞ্চ করা হয়েছে। নি:সন্দেহে ড্যানিয়েল ব্যাড বিহেভিয়ারের জন্য স্টার সেলিব্রেটি হয়ে গেছে রাতারাতি। যদিও খারাপ ব্যবহারের জন্য ড্যানিয়েলকে একটি এয়ারলাইন্স কোম্পানি ওদের প্লেনে ওর ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে।
এর আগে ড্যানিয়েলের বয়স যখন সাত বছর, তখন ওর মা বারবারা ক্যান্সার আক্রান্ত হলে মা-মেয়েকে কোনো এক টিভি শো”তে আনা হয়, সে অনুষ্ঠানে বারবারা তার মেয়েকে একজন বুঝদার মেয়ে হিসাবে উল্লেখ করেছিল। সাত বছর বয়সী ড্যানিয়েল ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের খেয়াল রাখতে মা’র সঙ্গে ঘুমাতো। ভালো মেয়ের গল্প দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারেনি।
বর্তমান স্টারডাম ড্যানিয়েল অর্জন করেছে ওর নেগেটিভ এটিচিউডের জন্য। মিডিয়া ওর ডিসঅর্ডারকে নিয়ে মাতামাতি করে ওকে উৎসাহিত করছে ভুল পথে এগিয়ে যেতে। ওর মা বারবারা ওর দায়িত্ব নিতে পারছে না বলে ড. ফিলের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি এখনও মেয়ের সঙ্গে আছেন এবং মেয়ের এই সেলিব্রেটি লাইফ উপভোগও করছেন। ড. ফিলের যেখানে ড্যানিয়েলের চিকিৎসা করে ওকে সারিয়ে তোলার কথা, তা না করে তিনি এই কেসটিকে প্রচার করে নিজের শো’র জনপ্রিয়তা বাড়াতে ব্যস্ত, অভিযোগগুলো ড্যানিয়েলের ডেপুটি শেরিফ বাবার।

ড্যানিয়েলের নিজের এই বিচিত্র জীবনকে উপভোগ করার সুযোগ মিডিয়া তৈরি করে দিয়েছে। বর্তমান সময়ে মিডিয়া একটি পাওয়ারফুল মাধ্যম, মিডিয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে যেমন কন্ট্রোল করে, তেমনি ড্যানিয়েলের মতো বখে যাওয়া কিশোরীকেও শেখায় কী করে নিজের উচ্ছৃঙ্খলতাকে পুঁজি করতে হয়।
অনেক অভিভাবক সন্তানদের খুব কড়া শাসনে রাখতে চায়, যাতে সন্তানের নৈতিক স্খলন না হয়। এই কড়াকড়ির কারণে দেখা যায়, অনেক সময় সন্তানের চরিত্রের যথাযথ বিকাশ হতে পারে না, এবং সে অনেকটা পরনির্ভর ব্যক্তিত্বহীন মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। আবার মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা যখন বলছে, হোক নিজের সন্তান তারপরও সন্তানের ওপর কোনো জোর খাটানো চলবে না। সন্তানের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতার আগ্রাসনে সন্তান বখে যাচ্ছে। বর্তমানের ছেলেমেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য অনেকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন গেজেট আর সহজলভ্যতাকে দায়ী করছেন।
তেমন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একাত্তর সনে এলভিস প্রিসলি আর বিটলস্ শুনে রুমি আজাদরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে আর একই বয়সী কামরুজ্জামান ধর্মের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে আলবদর কমান্ডার, এভাবে ভাবলে হিসাবটা কিন্তু মেলে না।
আবার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র থাকলেও একজন মানুষ শিক্ষিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুশিক্ষা আর স্বশিক্ষা একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে। আলোচিত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পরস্পর বিরোধী কিছু আচরণ প্রত্যক্ষ করলে বুঝা যায় মানুষের ডিসঅর্ডারন্যাসের রকমফের। আগের দিন যে ব্যক্তি সাধারণ মানুষের সঙ্গে বসে কালাই রুটি খান, পরের দিন সে ব্যক্তিই তাঁর সমান মর্যাদার একজন সংসদ সদস্যকে চড়-থাপ্পড় মারতেন দ্বিধা করেন না।
বিহেভিয়ার ডিসঅর্ডারন্যাস মানুষের জিনগত একটি সমস্যা, মানসিক রোগেরই একটি অংশ। এটি মানুষের অন্যান্য অসুস্থতার মতোই একটি অসুখ। এই অসুখেরও চিকিৎসা আছে। তবে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ বেশি কার্যকর। পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের সচেতনতা, আন্তরিকতা এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এই অসুস্থতা প্রতিরোধে সবচেয়ে ফলপ্রসু ভূমিকা পালন করতে পারে।