একটি পুরনো ছবি এবং অন্তর্গত ক্ষোভ

জেরিন আফরীন: আজ সকালে আমার ছেলেবেলার একটি ছবি খুঁজে পেলাম টাইম লাইনেআমার খুব প্রিয় একজন অনেক যত্নে ছবিটা পোস্ট করেছেন। মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। ছবিতে আমরা তিনবোন আর আমাদের প্রিয় মিথি (যে কিনা সেই সময়টাতে নিজেকে আমাদের প্রিটেনড বোন হিসেবে ভাবতো)। ছবিটা যখন তোলা হয়েছিল তখন আমার বয়স ছিল নয়, আমার মেয়েরও এখন নয় চলছে। তাই ছবিটা আমার কাছে অন্যরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো।

আমি একটু পর পর ছবিটা দেখি আর মেয়ের সাথে মেলাই। শেষমেশ ভাবলাম মেয়ের একখানা ছবির সাথে আমার ছবিটা কোলাজ করলে মিলগুলো হয়তো আরও বেশি স্পষ্ট হবে; সেখানেই বাঁধলো বিপত্তি। মনে পড়ে গেল আমার নয় বছর বয়সের সেই বিষাক্ত স্মৃতি।

আমি তখন ভয়াবহরকম খারাপ ছাত্র ছিলাম, প্রতি পরীক্ষায় আটটা বিষয়ের মধ্যে ছয়টাতেই ফেল মারি, দোয়া ইউনুস মুখস্ত রেজাল্টের সময় ওটাই জপতে থাকি। বাসাতে সারাক্ষণ তিরস্কার, হোম টিউটর এসে আম্মার আক্ষেপের ঝাল তুলে দুই হাতের পাতায় বেত ভেঙ্গে। কান্না আটকে স্যারের সামনে বসে থাকি, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি নীলশিটে পরা হাতের তালু। বাথরুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদি, স্যারকে অভিশাপ দেই, মনে মনে বলি, ‘দেখিস একদিন আমিও’। বাথরুম থেকে বের হয়ে আসি মুখ ধুয়ে, যেন কিছুই হয়নি।

স্যার ইংলিশে রচনা লিখতে দেয়, নীল হয়ে উঠা আঙুলে কলমের আঁকিবুকিটা স্লথ হয়ে ওঠে। এবার বন্ধ মুঠিতে হঠাৎ পড়ে স্কিপিং এর কাঠের হাতলের বাড়ি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে আর্তনাদ বের হয়ে আসে। চোখের পানি আর বাধ মানে নাস্যার চলে যায় এরপর শুরু হয় ফোন পর্ব, প্রতিবেশী খালাম্মারা আম্মাকে ফোন দিতে থাকে একে একে তাদের সন্তানদের সাফল্য শুনতে শুনতে আম্মাও মৃদু কণ্ঠে বলে, বড় আপি আর মুমু কতো ভাল করেছে। ইচ্ছে করেই ভুলে যায় আমার প্রসঙ্গটা। আপির রেজাল্টের সাথে সাথে ওর নোট বুকিং দেবার হিড়িক পড়ে খালাম্মাদের মধ্যে। আমি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করি আব্বার জন্য। জানি ওটাই ফাইনাল ইনিংস। আব্বা আসে অনেক রাতেআপি, মুমুর রেজাল্ট নিয়ে হালকা কিছু কথা বলে আব্বা আমার রেজাল্টটা হাতে নিয়ে ছুড়ে মারে আকাশ পানে। সেই রাতে আব্বা কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়ে, টিভি চলে না। আম্মা লুকিয়ে কাঁদে।

রাত বাড়ে আমার হাতের তালুটা ফুলে ওঠে, প্রচণ্ড ব্যথা হয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি আমি ফেল করে পুরো পরিবারকে যে পরিমাণ অপমানিত করেছি, তার তুলনায় এই ব্যথা কিছু না।

এরপর দিন কাটে, ফেলটু মেয়েটার প্রতি সবার বিরক্তি বাড়তে থাকে। আমি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। নিজে ছোট হয়ে সবাইকে খুশি করবার চেষ্টা করি। আম্মার সাথে সহজ হতে ঘরের কাজে সাহায্য করি। আব্বার দরকারি জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখি। সময় গড়ায়, আম্মা আমার সাথে যদিও সহজ হয়, আব্বা আমার সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দেয়আত্মীয়-স্বজন যে যখন আসে নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, আমার ফেল কাহিনী।

জেরিন আফরীন

বিশেষ করে আমার ছোটো চাচা প্রতি সেকেন্ডে স্মৃতিচারণ করেন বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে। ফেলের সিলটা আমার কপালে পড়ে যায় আজন্মের মতোই।

সেই শৈশব থেকেই আমি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বড় হতে থাকি আত্মগ্লানি নিয়ে; ছোটো-বড়ো সবাইকে খুশি করবার বৃথা চেষ্টায় হারিয়ে যায় আমার আত্মবিশ্বাস; হারিয়ে যায় আমার লেখা কবিতার মূর্ছনা, আমার আঁকা কমিকস এর প্রচারণা। শুধুমাত্র ছাত্র ভালো না বলে আমার সব প্রতিভা অবমূল্যায়িত হতে থাকে। নিজেকে গোত্রভুক্ত করবার তাগিদে একসময় রেজাল্টও ভালো হতে থাকে। কিন্তু আহা, আমার ভালো আর প্রত্যাশার মানদণ্ডতে ফারাক ছিল ব্যাপক। বিষয়টা অনেকটা হীরার জহুরির তামা মূল্যায়নের মতো। কাজেই ভালো হয়েও একটা পর্যায় পর্যন্ত স্বীকৃতিহীনতা আমাকে পুরোই আত্মবিশ্বাসহীন করে তুলে

গল্পটা এখানে শেষ হলেও আমি ভেঙ্গেচুড়ে যাই সারাজীবনের জন্য। যেকোনো ছোটখাটো সমস্যায় নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে, নিজেকে ছোট করে সবার মন জুগিয়ে চলার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। নিজের যেকোনো সিদ্ধান্তে আস্থাশীল থাকতে পারি না, ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিদ সমস্যায় জর্জরিত থেকে হতাশার মধ্যে ডুবে থাকি প্রায়ই

তাই আমার কাছে নয় বছর বয়সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নয় বছর বয়সে আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে ভুলে গেছি, আমার সত্ত্বাকে অবমূল্যায়িত করেছি এরপর থেকেই মেয়ের সাথে কোলাজ করা ছবিটার মধ্যকার পার্থক্যগুলো বড্ড স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আমি খুঁজে পেলাম ছবিতে নতমুখী বিষণ্ণ কিশোরী আমি’র পাশে আমার মেয়ের হাসিটা বড্ড প্রাণবন্ত, আর আত্মবিশ্বাসী। আমি কোনও মতেই এই আত্মবিশ্বাস হারাতে দেবো না।

আমার সন্তানের কাছে আমার একটাই প্রত্যাশা, তোমার যা ভালো লাগে তাই হও, কিন্তু বাঁচো মাথা উঁচু করে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে মৃতের মতো বেঁচে থাকা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সমান।        

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.