আপনার মেয়ের বিয়ে ১৬ না ১৮ বছরে?

বিপাশা দেবনাথ: তখন ক্লাস সেভেনে কী এইটে পড়ি, সে বছর মনে হয় গ্রেডিং সিস্টেমের সর্বপ্রথম পরীক্ষা ছিল। সন্ধ্যায় প্রাইভেটের পড়া শেষ করে মা আমাকে নিয়ে গেলেন আমার এক খালার বাসায়। খালার প্রতিবেশীর মেয়ে আগের বছর বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিলেন বলে আমার খালাতো বোন আর আমি ওই আপুর সঙ্গে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করছিলাম।

আমি মূলত দর্শক ছিলাম সেখানে। কী মনে করে আমার খালা, মা আর আর প্রতিবেশী আন্টির কথা কানে এলো। আন্টি বলছিলেন যে, তাঁর মেয়েকে উনি মেডিকেল থার্ড ইয়ারে থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেবেন, নয়তো পাত্রপক্ষ বুড়ি বলবে। আমার খালা বললেন, যে যুগ আসছে মেয়ে নিজের পায়ে না দাঁড়ানোর আগেই বিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। সেই আপুর বিয়ে শেষমেশ হয়েছিল মনে হয় এফসিপিএস করার সময় যতোদূর মনে পড়ে।  

গেল দুই বছরে হঠাত বিয়ের বয়স কত করা হবে সে নিয়ে বিশাল আলোচনা সমালোচনা হলো। সরকার এর মাঝে বিলও এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ আর ছেলেদের বিয়ের বয়েস ১৮, তাও কন্ডিশন এপ্লাইড। ঠিক যেমন মোবাইল আর ইন্টারনেট কোম্পানীগুলোর এডের শেষে এক কোনায় ছোট করে লেখা থাকে, শর্ত প্রযোজ্য অথবা সিগারেটের প্যাকেটে কোন এক কোণায় লেখা থাকে, সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর তেমন করেই। তা শর্ত টা কি? বিয়ের বয়স ১৮ এবং ২১ থাকবে যথাক্রমে মেয়ে এবং ছেলের জন্যে কিন্তু অভিভাবকের অনুমতিক্রমে ১৬ এবং ১৮ বছর বয়েসে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানের বিয়েশাদী করাতে পারবেন।

এই আইনের পক্ষে-বিপক্ষে হাজার কথা, হাজার স্ট্যাটাসে ফেসবুক ভেসেছে, অনলাইন ফোরামগুলোতে হৈহৈ রব হয়েছে, সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে কয়েক ডজন এবং বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি দেয়া হয়েছে সরকার-নাগরিক সমাজ দুপক্ষ থেকেই।

বিপাশা দেবনাথ

বিভিন্ন প্রত্রিকার খরব দেখে মনে হলো, গ্রামীণ ছেলে-মেয়েদের কথা মাথায় রেখেই এই আইনের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাথায় এসেছে। উদাহরণ হিসেবে সরকার বলছে পশ্চিমা দেশগুলোর কথা। নানান নিউজ পোর্টালের খবরের নিচে কমেন্টে এসেছে নানান মুখরোচক মন্তব্য, ১৮ বছরের বেকার ছেলের কাছে কি মেয়ে বিয়ে দেবে? আজকাল তো পয়সাওয়ালা ছাড়া বিয়ে দেয় না মেয়ে।

সব ছাড়িয়ে জাতীয় দৈনিকে ও জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানের একটা অকাট্য মন্তব্যে চোখ আটকে গেল, সেখানে উনি বলেছিলেন যে ১৬ বছরে মানসিক পরিপক্কতা আসে না, আর নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে না।

এই মন্তব্য আর বিবৃতিগুলো যখন পড়ছিলাম তখন ভাবছিলাম, এই যে কথায় কথায় কখনো আমেরিকা, কখনো ইউরোপ অথবা কখনো মালয়েশিয়ার প্রসঙ্গ আনা হয়, তখন কেউ কি একবার যাচাই করে দেখেন এরা আসলেই এমন কিনা যেমনটা সরকার পক্ষের লোকেরা বলছে? আমাদের মধ্যে যাদের পশ্চিমের দেশগুলোতে থাকার অভিজ্ঞতা আছে বা থাকছি, আমরা কি এমন কিছু দেখছি? এখানে যারা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করে, তাদের প্রকৃত অবস্থা আমরা কি আসলেই জানি বা জানার চেষ্টা করি?

আমার জার্মান বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওদের দেশে ১৬ বছর বয়সী একজন ছেলে বা মেয়ে কি বিয়ে করার অনুমতি পায়? তখন সে বলেছিল, ১৬ বছরে তুমি ৪ ঘন্টা কাজ করার অনুমতি পাবে, কিন্তু কোন ভারী কাজ করতে পারবে না। কিন্তু ১৮ হলে তুমি পড়াশোনার পাশাপাশি সপ্তাহে ১৯ ঘন্টা যেকোনো কাজ করতে পারবে। ওরা নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে কতটা সচেতন সেটা জানতে চাইলে আমাকে জানালো যে, ক্লাস ফাইভে থাকার সময়েই ওরা নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে স্কুলে জানতে পারে, ধীরে ধীরে তারা যৌন শিক্ষাগুলোও পায়; সাথে থাকে নিজের অধিকার নিয়ে সচেতনতা।

যেটা আমার বন্ধু স্কুল টিচার ইয়ান এবং সিসিলির মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কারণ এখানে টিনেজ বয়স থেকেই এরা সেক্সুয়ালি এক্টিভ হয়ে যায়। এরা জানে কোথায়, কেমন করে ইমার্জেন্সি পিল পাওয়া যায়, এরা জানে কোথায় এসটিডি চেকাপ করাতে হয়, এরা জানে কিভাবে নিজের খেয়াল রাখতে হয় আর নিজের অধিকার কী!

এখানে ছেলে-মেয়ে বোহেমিয়ান বা উড়নচণ্ডী যাই হোক না কেন, নিজের প্রাপ্য টিনেজ বয়স থেকেই বুঝে নিতে শেখে! আমার ১৬ বছর বয়সে আমি কি এতোটা জানতাম? নাহ জানতাম না এতো কিছু! এখনো জানি না আমার জন্যে বাংলাদেশের আইনে কী কী অধিকার আছে, ঠেকায় পড়ে আজকাল পড়ছি, জানার চেষ্টা করছি। আজকের ১৬ বছরের কিশোর-কিশোরী যতোই স্মার্ট হোক না কেন, কয়জন এই সাধারণ ব্যাপারগুলো জানে আমার সন্দেহ আছে!

“If you don’t like the road you’re on, start paving another one” – কথাটি  ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার সিনেমা Our Brand is Crisis এর নায়িকা সান্ড্রা বুলকের। সিনেমার একদম শেষ ডায়লগ ছিল এটা। ১৬ বছর বয়সের বিয়ে এবং এই ডায়লগের মাঝের সম্পর্ক কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। আর সেই প্রশ্নের উত্তরও আছে! সেটাই খোঁজার চেষ্টা করছি কিছু সময় ধরে।

সরকার আইন করেছে, আপনার মেয়ে, বোন অথবা প্রেমিকার বিয়ের দায়িত্ব কিন্তু নেয়নি। সেটা আপনার আমার দায়িত্ব। আপনার মেয়েকে আপনি কিভাবে মানুষ করবেন সেটা আপনার দায়িত্ব, আমার বোনকে আমি কিভাবে স্ব-নির্ভর এবং বুঝদার বানাবো সেই দায়িত্ব আমার, আমার পরিবারের প্রতিটা সদস্যের।

ধরে নিলাম, আপনি-আমি এই আইন মেনে নিয়ে নিজের মেয়ে/বোনের বিয়ে দিলাম ১৬ বছর বয়সে। এখন যদি তাঁর উপর নির্যাতন হয়, নির্যাতনের কারণে সে যদি খুন হয়, বা আত্মহত্যা করে তাহলে সেটার দায়ভার কিছুটা হলেও আপনার-আমার উপর বর্তায়। নিজের জীবনের দায়ভার আমরা ঠিকভাবে নিতে পারি না, আরেকজনের জীবনের দায়ভার কেন নেব? তাঁর চাইতে এটা ভালো না যে নিজের মেয়ে/বোনকে তাদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জানানো, নিজের পায়ে যেন সসম্মানে দাঁড়াতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দেয়া?

মেকাপ আর সুন্দর কাপড়ের চাইতেও যে স্বনির্ভর নারী অনেক বেশী সুন্দর সেটাও বুঝিয়ে দেয়া? নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারার স্বাধীনতা দেয়া ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যেই?
সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম, পরিবার আমাদের প্রথম স্কুল আর বাবা-মা আমাদের প্রথম শিক্ষক। আমাদের স্কুল এবং পড়াশুনা এখনো টেক্সট বইয়ের বাইরে যেতে পারেনি। স্কুলে তো জানানো হয় না কিভাবে আমাদের শরীরের খেয়াল রাখতে হয়, ভাল স্পর্শ, মন্দ স্পর্শ কেমন করে বুঝতে হয়, কেমন করে চারপাশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়, কেমন করে নিজের পরিচয় গড়তে হয় আর কোথায় আমাদের অধিকার!

বয়ো:সন্ধির সময় মাঝে মাঝে স্কুলে কিছু ডাক্তার এনে ক্লাস নেয়ানো হয়, যেটা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। এখানে পরিবার সম্পূরক হিসেবে আসতে পারে তাঁর সন্তানকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক সঠিক শিক্ষা দেয়ার জন্যে। সবসময় অন্য কেউ বা সরকার আপনার দায়িত্ব পালন করবে সেই ভাবনা যেমন ঠিক না তেমনি অন্যের দেখানো পথ সবসময় ঠিক হবে এমন কোন কথা নেই। নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ভাবুন কোনটা আপনার জন্যে ভালো,কোনটা মন্দ সেটা নিজের ছেলে বা মেয়েকেও শেখান।

আপনার আইন পছন্দ হয়নি, মনে হয়েছে সরকার ভুল করেছে, তাহলে সরকারকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিন কেন ভুল করছেন তারা, কোথায় ভুল! এ ব্যস্ত সময়ে রাজপথের আন্দোলন শুধু টিভির পর্দায় আর ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকে। এর থেকে বের হয়ে নিজের ঘর থেকেই একটু অন্যভাবে বদল শুরু করা যায়। এই বদলে যাবার অঙ্গীকার নিয়ে আসা সরকারকে কি বুঝিয়ে দেয়া যায় না যে বদলটা গোড়া থেকেই করতে হবে?

একজন নারী রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে এমন আইন পাওয়া খুবই দুঃখজনক, কিন্তু তাই বলে সেটা মেনে নেয়াও যুক্তিযুক্ত না। আমাদের সরকারে থাকা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা যতই ভিনদেশের উদাহরন দিক না কেন তাতে করে বাংলাদেশ চোখের পলকেই বিদেশ হয়ে যাবে না, বিদেশে একজন বাচ্চা ছোট থেকে যে সুবিধা পায় সেটাও সরকার দিতে পারবে না।

যেটা আমার বাস্তবতা না সেটা নিয়ে শুধুই আফসোস করা বা অন্ধ অনুকরন করলেই সেটা বাস্তব হয়ে যাবে না। সমাধান সেখানে একটাই আমাদেরকে প্রতিনিয়ত আমাদের নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে স্ব-শিক্ষিত, স্ব-নির্ভর,দায়িত্বশীল এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্নভাবে গড়ে দিতে হবে।

যতো আইন আসুক না কেন, ১৬ আর ১৮ বছরের প্রতিটা ছেলেমেয়ে মাইনরই থেকে যাবে! একজন অভিভাবক হিসেবে তাই আপনাকেই ঠিক করতে হবে আপনার সন্তানের বিয়ের বয়স কত হবে!

১৯ ফেব্রুয়ারি,২০১৭, ড্রেসডেন।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.