দেবী থেমিস’কে বলছি …

সেবিকা দেবনাথ: আসা যাওয়ার পথে দেখছি সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনের চত্বরে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ভাস্কর্যটি একজন নারীর। শাড়ি পরিহিতা ও চোখ বাঁধা ওই নারী বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা এবং ডান হাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘গ্রিক দেবী থেমিস’-এর আদলে এই ভাস্কর্য তৈরি করেছেন মৃণাল হক। এই ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার জন্য হুমকি ধমকি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। তবে হেফাজতের সমস্যাটা কোথায় তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। এই ভাস্কর্য সরানোর দাবি জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফি এক বিবৃতিতে বলেছেন, গ্রিক দেবির মূর্তি স্থাপন করে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যে আঘাত করা হয়েছে। তার ভাষায়, গ্রিক দেবির যে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আদর্শিক চেতনার বিপরীত। তার বক্তব্য হচ্ছে, গ্রিক দেবী থেমিসের গায়ে শাড়ি পরিয়ে, এটিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্য প্রমাণের অপচেষ্টা করা হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।

সংগঠনের মহাসচিব মো. জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছেন, ‘আমরা ভাস্কর্য এবং কোনো সংস্কৃতির বিরোধী নই। বাংলাদেশের ঐতিহ্য বা ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে মিল রেখে ভাস্কর্যটি করা হলে আপত্তি ছিল না। কিন্তু এটি গ্রিক দেবিকে হায়ার করে এনে করা হয়েছে। সেজন্যই আমাদের আপত্তি।’

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো সংগঠনের আমির দেশের ঐতিহ্য নিয়ে চিন্তিত। তাদের সমস্যা কি শাড়িতে? নাকি নারী মূর্তিতে? নাকি ইসলামি এতো দেশ থাকতে গ্রিস থেকে কেন ধারণা নেয়া হলো তাতে? শাড়ির পরিবর্তে স্কার্ফ বা গাউন থাকলে কি তারা আপত্তি করতো না? বোরকা হলে কি খুশি হতো? নারী না হয়ে তা যদি পুরুষ মূর্তি হতো, তাহলে কি ওরা ভাস্কর্যের বিরোধিতা করতো না?

যদি তা-ই হয় তাহলে বিমান-বন্দরের গোলচত্বরে সামনের ভাস্কর্য নিয়ে কেন বিরোধিতা করেছেন? গ্রিস থেকে না এনে এই ভাস্কর্যের ধারণা যদি পাকিস্তান, সৌদি আরবের মতো দেশ থেকে আনা হতো তাহলে কি সব ঠিক থাকতো? এখানে বলা দরকার যে ইরানে ইসলামি হুকুমত ও শরিয়া আদালত বিদ্যমান রয়েছে, সেখানেও উচ্চতর আদালতের দেয়ালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘জাস্টিসিয়া’ ভাস্কর্য খোদাই করা রয়েছে।

ইতোমধ্যে তাদের দাবির মুখে বিমান বন্দরের সামনে থেকে ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ নামের ভাস্কর্যটি সরানো হয়েছে। সেখানে ছিলো বাউল সাধক লালন শাহ্সহ পাঁচ বাউলের প্রতিকৃতি।  এরই মধ্যে পাঠ্যপুস্তকে নিজেদের চিন্তা ধারার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এখন চাইছে সবক্ষেত্রে যেন তাদের চিন্তাধারাই প্রতিফলিত হয়। এটাই স্বাভাবিক। প্রভাব সবাই বাড়াতে চায়।

দেবী থেমিস নিশ্চয়ই ভাবছেন, ‘কোথায় এলাম রে বাবা! আসতে না আসতেই হটানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। নূন্যতম সৌজন্য বোধ নেই।’

দেবী থেমিস’কে বলছি, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমরা সৌজন্য বোধ হারাচ্ছি। এখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের বইয়ের প্রথমেই অজ (ছাগল) গাছে চড়ে আম খায় শেখানো হয়। প্রথমেই তাদের পরিচয় করানো হচ্ছে ছাগলের সাথে। আপনি এদেশে কতদিন থাকতে পারবেন জানি না। যারা আপনার পিছু নিয়েছে তারা আপনাকে স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। এর আগেও ওরা ভাস্কর্য অপসারণের দাবি করেছে এবং সফল হয়েছে। পাঠ্য পুস্তকে ওদের চাপিয়ে দেয়া চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছে। আপনি ন্যয় বিচারের প্রতীক। কিন্তু এদেশে আপনি ন্যায় পাবেন কি না তা অনিশ্চিত। কেননা আমরা উল্টো দিকে হাঁটছি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.