নারীবাদ কি শুধু ‘শিক্ষিত’ নারীর মতবাদ?- পাঠ প্রতিক্রিয়া

ফারজানা শারমীন সুরভি: লেখক ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়াকে ধন্যবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখার জন্য। লেখাটি ভালো লেগেছিল। কিন্তু একমত হতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, শান্তা মারিয়ার লেখাটিতে নারীবাদী হওয়ার জন্য একটি threshold নির্ধারণ করা হয়েছে। যেটা হচ্ছে, Simone de Beauvoir সহ নারীবাদী সব বইপত্র পড়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করলে তবেই একজন দাবী করতে পারে যে- “হ্যাঁ, আমি নারীবাদী”।

ফারজানা সুরভী

কিন্তু একটা হাইপোথেটিক্যাল সিচুয়েশন কল্পনা করা যাক। বাংলাদেশের কোনো এক গ্রাম। সেখানে ফতোয়াবাজদের চোখ রাঙ্গানি আর পুরুষতন্ত্রের দাপটের মধ্যে সারাটা জীবন পার করেছেন এক নারী। তারপরেও তিনি স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ফুলকপির চাষ করেন এবং সেখান থেকে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেছেন। তাঁর ‘স্বামী’ দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তাই তিনি সিঙ্গল মাদার এবং দুই ছেলে মেয়েকে তাঁর একাই দেখাশোনা করতে হয়। তাঁর ছেলে সন্তানটিকে তিনি স্কুলে পাঠা্ন। মেয়ে সন্তানটিকেও তিনি স্কুলে পাঠা্ন। মেয়ে সন্তানটির বাল্যবিবাহের কথা তিনি চিন্তাও করেন না, শত সামাজিক চাপ সত্ত্বেও। আমার কাছে, গ্রামের এই লেখাপড়া না জানা নারীটি তো অনেক Simone de Beauvoir পড়া নারীর চেয়েও বেশি প্র্যাক্টিসিং ফেমিনিস্ট।

ফেমিনিজমকে আমরা যদি শুধু পড়াশোনা জানা এবং নারীবাদের থিয়োরি জানা এলিট সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ করে রাখি, তাহলে কি কখনো নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার পাবে? তাহলে কি কখনো সব পর্যায়ে-সমাজের সকল স্তরে নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে? হ্যাঁ, নারীবাদ বিষয়ক পড়াশোনা অবশ্যই একজন নারীবাদীর চিন্তার ভিত্তিকে আরো শক্ত করবে। কিন্তু নারীবাদী বইপত্র পড়া কি নারীবাদী হওয়ার প্রি-রিকোয়ারমেন্ট হতে পারে?

আমার বড় বোন ডাক্তার। তাকে একাধারে পড়াশোনা, ডাক্তারি, সংসার, সন্তান, সামাজিকতা- সব কিছু সামলাতে হয়। এটা দেখে আমার বাবা একবার বলছিলেন, “মেয়েরা আসলে সংসার এবং সন্তানের জন্য ক্যারিয়ারে অনেক পিছিয়ে যায়। কিন্তু সেই মেয়েটার যোগ্যতা হয়তো কম থাকে না”। আমার বাবা কি “mommy track” জারগনটি জানতেন? না! তারপরেও নিজের কন্যাকে দেখে তাঁর মধ্যে এই বোধটা তৈরি হয়েছিল। এমন জ্ঞানপাপীর সংখ্যা তো কম নয় সমাজে- যারা Simone de Beauvoir থেকে Virginia Woolf-সব গুলে খেয়েও পুরুষতান্ত্রিক। এমনকি হয়তো বাসায় গিয়ে বউ পেটায়!!

আমেরিকাতে এক নারী প্রফেসরের সাথে গবেষণার কাজ করি। উনাকে ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি বিয়ে না করে লিভ ইন রিলেশনশিপে আছেন কেন?”। তো ওই ইন্টারভিউ বোর্ডে যে বুড়ো বুড়ো প্রফেসররা বসে ছিলেন, তাদের পড়াশোনার লেভেল চিন্তা করা যায়! হয়তো জেন্ডার লেন্স দিয়ে কিভাবে পলিসি এনালাইসিস করা যায়, এ বিষয়ে একেকজনের পি এইচ ডি ডিগ্রী আছে। তাও এই জ্ঞানপাপীরা একজন নারী প্রফেসরকে অবলীলায় জাজমেন্টাল ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছেন, “আপনি বিয়ে না করে লিভ ইন রিলেশনশিপে আছেন কেন?” কোনো পুরুষ প্রফেসরকে কিন্তু এই নিয়ে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।

কিছু মানুষ আছেন, যারা না জেনেই বলে বসেন “নারীকে এগিয়ে রাখার নাম হচ্ছে নারীবাদ। আমি নারীবাদী না, আমি মানবতাবাদী”। এই তালিকায় বাংলাদেশের তথাকথিত “আঁতেল” লোকজনও আছেন। এইসব কথা শুনলে আমার বিরক্ত লাগে। মনে হয়, “ইনি তো নারীবাদের বেসিক ডেফিনিশন না জেনেই প্যাঁচাল পাড়তে আসছেন।” নারীবাদের ব্রিফ ডেফিনিশন বলছে- সোশ্যাল থেকে পলিটিক্যাল, পারসোনাল থেকে ইকোনোমিক প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর “নারী” পরিচয়ের কারণে যে ডিস্ক্রিমিনিশনের শিকার হতে হয়, সেটা বিলুপ্ত করার কথা।

হ্যাঁ, এই ‘মানবতাবাদীদের’ দেখলে অবশ্য নারীবাদ নিয়ে পড়াশোনা অনেক জরুরী মনে হয়।  মনে হয়, এরা কেন নারীবাদ নিয়ে না পড়া-শোনা করে নারীবাদকে Demonize করার চেষ্টা করছেন! কিন্তু যারা Simone de Beauvoir কিংবা Virginia Woolf কিংবা Mary Wollstonecraft না পড়েও নারীবাদের চর্চা করছেন, তাদেরকে আমি “অনারীবাদী” বলে অগ্রাহ্য করবো কেন? বরং তারা কি আরো বেশি সম্মানের যোগ্য নয়?

এবার আসি, নারীবাদের মধ্যকার বিভিন্ন বিতর্কিত ধারা নিয়ে। শান্তা মারিয়ার লেখাটিতে “চুল ছেঁটে ফেলা”/ “সংসার থেকে বেরিয়ে এলেই নারীর মুক্তি” এই আইডোলজিগুলোকে হঠকারী বলা হয়েছে। যদিও এই আইডোলজিগুলোতে আমি বিশ্বাস করি না, তারপরেও আমি এটাকে ইতিবাচক দিক থেকে দেখছি। নারীবাদ একটা আম্ব্রেলা। এই আম্ব্রেলার আন্ডারে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মতবাদ এবং ধারা ডেভলপ করবে। এটাই স্বাভাবিক। কাল হয়তো একজন “বইপত্র না পড়া” “হঠকারী” নারীবাদী আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবেন, “এহ! সাইজা গুইজা বিয়া করছে। সারাক্ষণ মুখে মেকাপ মারে। ট্র্যাডিশনাল বাঙ্গালী মেয়েদের মতো মাথার চুল লম্বা লম্বা। ও আবার কিসের নারীবাদী?”

তারপরেও আমি ঝুঁকি নিয়ে বলবো, এইসব মতবাদকেও আমি গুরুত্বের সাথে নিব। কারণ আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য একই। হয়তো পদ্ধতি ভিন্ন। Radical feminism এর নাম শুনলে বাংলাদেশের তথাকথিত পড়াশোনা জানা লোকজন হা রে রে রে করে তেড়ে আসে। কিন্তু ” Radical feminism focused on creating a ‘woman-space’ through alternative institutions and organizations to fulfill women’s needs: putting medical care into women’s own hands, and creating women’s health centers; creating battered women’s shelters and rape crisis centers as ways to address troubling violence against women; providing skills often associated with men which women traditionally lacked, such as auto mechanics and carpentry; as well as establishing cultural organizations such as book stores, art galleries, film, music festivals, to nurture women’s cultural expression. These spaces were needed to support, nurture and revalue what is devalued in ‘malestream’ culture (Calás & Smircich, 2006, p. 295)”। চিন্তা করা যায়, কতো বড় অবদান এটি? আজকে এই যে রেপ ক্রাইসিস সেন্টার দেখি নারীদের জন্য বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার নারীর জন্য শেল্টার হাউজ দেখি- এই ধারণাটাকে Radical feminism ফোকাস করেছিল।

ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজমের অনেক সমালোচনা আছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে গিয়ে অনেক সময় ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজম অনেক নারী অধিকার বিরোধী গোলমেলে কনসেপ্টকেও নারী অধিকারের আম্ব্রেলার নিচে নিয়ে আসে। কিন্তু যখন দেখি “Transnational/ (post) colonial feminism, while not monolithic, include several critics who challenge Western feminist theorizations of gender and gender relations as furthering the images and social experiences of mostly privileged women (and men) in the ‘First World’. These arguments go beyond those raised by black and other race theorists who questioned the white, middle class, heterosexist, representations of gender in feminist theorizing, and interrogate, for instance, the function of ‘the nation’ in gendering and racializing ‘others’ through specific, patriarchal, heterosexist, political projects between and within different countries (e.g. Alexander 1997; Monhanram 1998; Collins 200b) (Calás & Smircich, 2006, p. 317)”, তখন ভালো লাগে। ভালো লাগে যে, এই প্রথম কোনো নারীবাদী ধারা পাশ্চাত্য বিশ্বের হেটেরোসেক্সুয়াল- শ্বেতাংগ নারীদের সোশ্যাল এক্সপেরিয়েন্স এর বাইরে গিয়ে ধারণ করার চেষ্টা করছে পুরো বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের নারীদের রিয়েলাইজেশনকে।

আমি হাই স্কুলে থাকতে প্রথম নারীবাদের সাথে পরিচিত হই “নারী” বইটার মধ্য দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও গ্লাস সিলিং জারগন আমি জানতাম না। কিন্তু আমার এক্সপেরিয়েন্স আমাকে বলতো অনেক অরগানাইজেশনে নারী যোগ্যতম হওয়া সত্ত্বেও তার “নারী” পরিচয়ের কারণে Top hierarchy তে যেতে পারে না। অনেক পরে জানলাম, এটাকে বলে গ্লাস সিলিং। গ্লাস সিলিং হলো, “those artificial barriers based on attitudinal or organizational bias that prevent qualified individuals from advancing upward in their organization into management-level positions” (U.S. Dept. of Labor, 1991)। তাহলে আমাদের এক্সপেরিয়েনস বা মানবতাবোধ কি অনেক সময় থিয়োরেটিক্যাল নলেজের চেয়েও দক্ষভাবে আমাদেরকে নারীবাদের পাঠ দেয় না? দেয় তো!

এই যে বাংলাদেশের নারী নীতি ২০১১ নিয়ে religion-based interest group গুলো এতো হাংগামা করলো! আমাদের দেশের লিগ্যাল সিস্টেম সেকুলার। কিন্তু পারিবারিক আইন হলো ধর্ম নির্ভর। নারীদেরকে সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিতে চাইলেই কিংবা ফতোয়া নিষিদ্ধ করতে চাইলেই দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মনে পড়ে যায় যে, “আমরা মুসলমান। কুরান-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন আমরা মানবো না। শরীয়া আইন হলো সর্বোত্তম”।

একইভাবে, এবরশন পলিসির প্রসংগ আসলে ‘সেকুলার’ আমেরিকার কনজারভেটিভদের মনে পড়ে যায়- “আমরা খ্রিস্টান। আমরা বাইবেল ভায়োলেট করবো না। ঈশ্বর পাপ দেবেন”। পাবলিক পলিসির জেন্ডার ফ্রেমিং নিয়ে কোনো নলেজ না থাকা সত্ত্বেও এসব দেখে আমার মনে হতো, এইখানে একটা জেন্ডার পলিটিক্স আছে। পাবলিক পলিসি নিয়ে পড়তে গিয়ে পরে আবিষ্কার করি, গবেষকরা পলিসি মেকিং-এ জেন্ডার পলিটিক্স নিয়ে আস্ত আস্ত বই লিখে রেখেছেন। নারী আজকাল সংসার করে, চাকরি করে, বাচ্চার স্কুলে অভিভাবক হিসেবে নিয়মিত নেটওয়ার্কিং রক্ষা করে দশ হাতে সব সামলাচ্ছে। বুঝতাম যে, নারীর প্রতি সমাজের এবং পরিবারের এই আকাশচুম্বী প্রত্যাশা নিশ্চয়ই অন্যায়। পরে এসে সুযোগ পাই, নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া এই ‘third shift’ বা unpaid community care work নিয়ে গবেষণা পড়বার। বাস্তবের সাথে থিয়োরিকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাই তখন।

আমি নারীবাদ নিয়ে পড়াশোনার আগেও যতোটা নারীবাদী ছিলাম, এখনো ঠিক ততোটাই নারীবাদী আছি। হ্যাঁ, এখন নারীদের প্রতি বৈষম্যের জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে অনেক মিসিং লিঙ্ক খুঁজে পাই। তাত্ত্বিক জ্ঞান আমাকে সাহায্য করেছে এই মিসিং লিঙ্কগুলো খুঁজে বের করতে। তাত্ত্বিক জ্ঞান আমাকে সাহায্য করেছে অস্পষ্ট পটভূমিকে স্পষ্ট করতে।

তাই, নারীবাদ নিয়ে পড়াশোনার গুরুত্ব অস্বীকার করছি না। কিন্তু নারীবাদের ডানা কেটে আমরা যদি শুধু পড়াশোনা জানা এবং নারীবাদের থিয়োরি জানা এলিট সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ করে রাখি, তাহলে কি কখনো সব স্তরে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা হবে? না, হবে না। নারীবাদকে উড়তে দিন। ভিন্ন ভিন্ন ধারা বিকশিত হতে দিন। থিয়োরির তোয়াক্কা না করেই।

গ্রামের ফতোয়ার শিকার নারীকে রক্ষা করার নারীবাদ”, “তাদের সুস্থ রিপ্রোডাকটিভ হেলথ নিশ্চিত করার নারীবাদ”, “হিন্দু-আদিবাসী কিংবা সংখ্যালঘু নারী পরিচয়ের কারণে ধর্ষিত নারীকে রক্ষা করার নারীবাদ”, “কন্যা ভ্রুণকে রক্ষা করার নারীবাদ”, “মাই বডি, মাই চয়েস এর নারীবাদ”, “ফ্রি দ্য নিপল মুভমেন্ট এর নারীবাদ”, “চুল ছোট করার নারীবাদ”, “মাতৃত্বকে মহিমান্বিত কিংবা অস্বীকার করার নারীবাদ”, “বিয়ের মুখে লাথি মারা কিংবা বিয়েকে ভালোবাসার নারীবাদ”, “সমপ্রেমী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার নারীবাদ”, “উইমেন অফ কালারের অধিকার প্রতিষ্ঠার নারীবাদ”, “পোশাকের স্বাধীনতার নারীবাদ”, “জরায়ুর স্বাধীনতার নারীবাদ”, “প্রাচ্যের নারীবাদ”, “পাশ্চাত্যের নারীবাদ”-সব ধরনের নারীবাদী ধারা ডেভলপ করুক। সমস্যা কী? আমার বিশ্বাস, সবচেয়ে প্র্যাগম্যাটিক এবং একুরেট ধারাটিই শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.