সুচিত্রা সরকার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনে গিয়ে শেষ হয় মিছিলটি। একঝাঁক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়(?) তরুণের হাতে ধরা ব্যানারের হেডিং ‘ভালবাসা (প্রেমিকা) বঞ্চিত সম্প্রদায়’। ঘুরে এসেছে কেন্দ্রিয় লাইব্রেরি আর টিএসসি।
দাবি ‘আমাকে ভালবাসতেই হবে’। ‘কেউ পাবে তো, কেউ পাবে না, তা হবে না, তা হবে না’- ইত্যাদি ইত্যাদি লেখা ব্যানারটায় সূর্যসেন হলের নামটা স্পষ্ট।
ছোট পত্রিকায় গুরুত্বহীন ট্রিটমেন্টে দেয়া একটি নিউজ। তাই দেখে কেউ বাকরুদ্ধ। মুখ টিপে হাসছে একদল। ছিঃ ছিঃ করছে কয়েকজন সমাজ-সচেতন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধরে টানাটানি করছে জনা দশেক। বাকিরা অবধারিতভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় (ঘটনাটা যদি কোনো ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা ঘটাতো, বড় বড় হেড লাইন দেখতে খুব চেষ্টা করতে হতো না, হলপ করে বলতে পারি)।
ব্যাপরটাকে যারা ছেলেমানুষী ভাবছেন, বড় ভুল করছেন। যারা ভাবছেন, নিছক খেয়াল, তারাও ডুবে আছেন ভেলকীবাজিতে। আর যারা ভাবছেন, প্রেম তো এমনই, কোনো বাঁধা মানে না, লাজ- লজ্জার পরোয়া করে না, তারা দিন গুনতে থাকুন।
দিন গুনুন আরেকটা বা আরো কয়েকটা দুঃসংবাদ পাওয়ার। কারণ এটা খামখেয়ালী বা অবুঝ প্রেমের প্রতিক্রিয়া নয়। এই মিছিল আর সমাবেশ পুরুষের কতৃত্ববাদী মনোভাবের ড্রেস রির্হাসাল। ভালবাসা নয়, এটা পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনের প্রদর্শন মাত্র। আগাম সংকেত। যে আগ্রাসন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছোট্ট রিশার শৈশবকে করেছে তছনছ। শেষপর্যন্ত বাঁচতেও পারেনি মেয়েটা। খাদিজার জীবনকে পাল্টে দিয়েছে এক ঝটকায়!
পুরুষের যে তাণ্ডবের কারণে দেশের অধিকাংশ নারীর জীবন কাটে শংকায়। কে বলতে পারে, গত পরশুর মিছিলটা শেষ করে, ওদেরই মধ্যে কেউ ‘চাপাতি কাণ্ড’ ঘটানোর পরিকল্পনা করেনি! ভালবাসা দিবসে যারা ব্যানারে-মিছিলে অভিনব উপায়ে নিজের দাবিটা জানিয়েছে, ভালবাসার কথা চাউর করেছে, কাল তারা বদরুল হবে না, এ গ্যারান্টি কে দিয়েছে? আজ যে ছেলেরা মিষ্টি হেসে ‘ভালবাসি’ বলছে, প্রত্যাখ্যান পেয়ে, কাল তারা এসিড ছুঁড়বে না, এর নিশ্চয়তা দেয়া যায়?
যায় না। কারণ উদাহরণগুলো আজও টাটকা। তরতাজা। প্রেমে প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে না পেরে (জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, ‘পুরো ঘটনা রাগের মাথায় ঘটে গেছে’) আম্বরখানা এলাকা থেকে মাংস কাটার চাপাতি কেনেন বদরুল। খাদিজাকে ‘আচ্ছাসে’ শায়েস্তা করতে! কত বড় সাহস বালিকার! পুরুষের দাবি অগ্রাহ্য করে! অতঃপর খাদিজার মাথা, হাত, পা শতচ্ছিন্ন! প্রেম প্রত্যাখ্যান করার ফলস্বরুপ উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের রিশাকে মরে যেতে হয়, সাভারের কল্পনাকে লড়তে হয় মৃত্যুর সঙ্গে। এর মধ্যে কেউ বেঁচে ফেরে, কেউ হয় লাশ। তবু জল্লাদের (পড়ুন আগ্রাসীদের) উল্লাস থামে না।
প্রেমটা একেবারে নিজস্ব। কাকে ভালবাসবো, কাকে নয়, এটা একান্তই নিজের সিদ্ধান্ত। চাপিয়ে দেয়াটা অস্বাস্থ্যকর! জোর জবরদস্তিও। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাখান করাটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না ছেলেরা।
কারণটা খুঁজতে হিল্লি-দিল্লি ঘুরে আসতে হবে না। কারণটা হাতের নাগালেই। ভাবুন একবার! ক্যাম্পাসে শিক্ষার জন্য, সুন্দরবনের জন্য, সাঁওতালদের জন্য মিছিল হলে জলকামান কেঁপে ওঠে। লাঠিচার্জ আর টিয়ারগ্যাসের তাণ্ডব। সেরকম একটা ‘হীরক রাজার প্রশাসন’ কেমন করে এই মিছিল মেনে নিল?
মেনে নিল পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার কারণে। ‘পুরুষ পুরুষ’ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। ছেলেরা আকছার এমন করে। করেই থাকে। এটাই তো স্বাভাবিক!
ছেলেরা সাহসী হবে। মেরে-কেটে, ভেঙে-চুরে, দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে- এটাই লেখা আছে পুরুষতন্ত্রের ‘পাঠ্যবই’টাতে। তারা মনের কথা চিৎকার করে বলবে। নির্লজ্জভাবে। যা চাইবে, দরকার হলে সেটা কেড়ে নেবে। তাদের জৈবিক ক্রিয়ায় আড়াল বলে কোনো শব্দ নেই। এই শিক্ষাই তো তারা পায় সমাজ থেকে। পরিবারের কাছে।
পুত্রসন্তানদের কেউ শেখায় না- তুমি কথা বলবে নিচু স্বরে, হাসবে মৃদু, কাঁদবে নিঃশব্দে। পুরুষতন্ত্রের এঁদো-পঁচা পাঠ্যবইটায় লেখা আছে-এসব মেয়েলি ব্যাপার। সমাজের যে ছেলে এমনধারা, সে ‘পুরুষ’ নয়। তৃতীয় লিঙ্গ বলে শ্লেষ জমা পড়ে তার ঝুলিতে।
পরিবারগুলো পুরুষকে কেন্দ্র করেই ঘোরে (সূর্য আর তাঁর নয়টি গ্রহ-কল্পনা করুন)। ছেলে জন্মালে ঘরের বাতিটা উজ্জ্বল হয়। বংশের বাতিটা যে তার হাতেই বাঁধা। আযান আর উলুধ্বনির মাত্রা বাড়ে ছেলে পয়দা হলেই। কন্যাসন্তানের মায়ের জোটে গঞ্জনা। ছেলের আকিকায় মহাধুম। খৎনা, পৈতা পড়ানো আর ভাই ফোঁটার কেন্দ্র ছেলেটিকে ঘিরেই। সবে ধন নীলমনি। মেয়েদের ওসব উৎসব নেই। আয়োজনশূন্য অনাড়ম্বড় জীবন নিয়ে বেড়ে ওঠে মেয়েরা। পুত্রসন্তানটি এই দেখে দেখেই বেড়ে ওঠে। যত বড় হয়, মগজে আর শরীরে বাড়ে, ছেলেটি দেখে পরিবারে তার প্রাধান্য। সমাজে অগ্রাধিকার।
আর মেয়েরা, আমার সমাজে ,মেয়েরা পড়ালেখা করলে বৃত্তি পায়। কেউ কেউ বলবেন, দেখো, কত সুযোগ দিয়েছে মেয়েদের এ সমাজ। কত জায়গায় কোটা ব্যবস্থা। চাকরিতে কোটা, শিক্ষায় কোটা, সংসদে কোটা, এমনকি বাসের সিটেও কোটা ব্যবস্থা। আসলে এইসব কোটা ব্যবস্থার মূল উৎপাটন করলেই দেখতে পারবেন, মেয়েরা কতোটা খারাপ অবস্থায় আছে (অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্যই কোটা)।
শুধু সমাজ জীবনে নয়। শিল্প- সাহিত্য- সংস্কৃতিও পুরুষতান্ত্রিক। এ সমাজে লম্পট কৃষ্ণ চিরকালের বীর। রামের সতিত্ব বলে কিছু নেই। অগ্নিপরীক্ষা সীতার। এ সমাজে যে পুরুষ, ইতিহাসের চরমতম অবমাননা করে নারীকে, সে-ই ভোটে জিতে যায়। গল্প- গানে পুরুষের বীরত্ব। পুরুষের দশটা বিয়ে, শ’খানেক পরকীয়া প্রচলিত আইনে সিদ্ধ।
হাল আমলের সিনেমা দেখলে তো শিউরে উঠতে হয়। সেখানে ইভটিজিং টাই প্রেম। নায়কোচিত কাজ। একটা ছেলে সিটি মারলো, গোলাপ ছুড়ে প্রেম নিবেদন করলো, মেয়েটা দুই মিনিট গাঁই-গুই। রেগে চলে গেল। দ্বিতীয় দিন, ছেলেটির সেই আগ্রাসী নিবেদনের কাছে হার স্বীকার। অতঃপর গল্পের রেললাইন চললো প্রেমনগরে!
শিল্পকলা নাকি সমাজের আয়না। তো, সেই আয়নায় যখন ভেসে ওঠে পুরুষের সামন্তচিন্তার এরকম নমুনা, বাস্তবের পুরুষটি তো তাই শিখবে। তারা ভাববে, এটাই স্বাভাবিক। অথবা সিনেমার নায়কের চেয়ে আরো কতো সাহসী ভঙ্গিতে প্রেম নিবেদন করা যায়। পুরুষটি মনে করে, যে কাউকে, যে কোনোভাবে পাওয়াটাই তার জন্মগত অধিকার। সতত পুরুষতান্ত্রিক মনের সলতেয় আরেকটু উসকে উঠে অহংকার। আত্মম্ভরিতায় পূর্ণ থাকে মস্তিস্ক। মগজ।
প্রেমিক পুরুষটি হোক অযোগ্য, ভাঁড়, মাথামোটা, অকেজো। তবু সে পুরুষ। সমাজের চালক। নারীর নিয়ন্ত্রক। এই আগ্রাসী মনোভাব থেকে সে বেরুতে পারে না। এরকম মনস্তত্বের একজনকে (সুপিরিয়র কমপ্লেক্সধারী পুরুষ) যখন কোনো একজন নারী প্রত্যাখ্যান করে, পুরুষটির অহংবোধ দুমড়ে যায়। তার চিরচেনা দেখা সমাজকে সে দেখে উল্টো করে। তার সামাজিক ‘গুণমন্যতার’ জারিজুড়ি মুহূর্তেই ভ্যানিশ! তখনই ব্লাস্টআউট করে সে। রেগে যায়। বনের ‘হেরে যাওয়া সিংহ’টার মতো তর্জন- গর্জন শুরু করে সে।
প্রথমে নিরবে। তারপর প্রকাশ্যে মিছিল করে। ঢিল ছোড়ে। ধর্ষণ। গণধর্ষণ। অথবা ‘পুরুষসিংহে’ প্রবল রাগের কারণে কয়েকজন ‘খাদিজা’র মাথায় চাপাতির সম্পাদ্য আঁকা হয়। আর ‘পুরুষসিংহটি’ হয়ে ওঠে বদরুল! সুতরাং ‘এখনি অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা’।
১৬.২.২০১৭
দুপুর ১.৫৬ মিনিট
দারুস সালাম, ঢাকা