শাশ্বতী বিপ্লব: বলেছিলাম তন্বী তরুণীদের কথা, সম্মুখে যাদের অবারিত জীবন। তাদের নিজেকে ভালোবাসার কথা। কিন্তু যারা পেরিয়ে এসেছো তারুণ্যের সেই উত্তাল সময়, কিন্তু নিজের জন্য নিজের করে রাখোনি কিছুই, তোমাদের ভালোবাসার, তোমাদের স্বপ্নের কী হবে?
হ্যাঁ, আ্মি তোমাদের কথা বলছি, যারা দাঁড়িয়ে আছো মাঝ বয়সে। ফেলে আসা স্বপ্নগুলোর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস গোপন করছো। যারা প্রতিদিন নিজেকে ভোলাও মিথ্যে সান্ত্বনায়।
ভাবো, ভালোই তো আছি। নানা রঙের দিনগুলি হারায়নি তো মোটেও, সোনার খাঁচাতেই তো আছে।
তাদের বলছি শোনো, স্বপ্নেরা তোমার সত্যি সত্যি সোনার খাঁচাতেই আছে। মুক্তি মেলেনি ওদের, ওড়েনি ওরা খোলা আকাশে। বরং তুমিও ঢুকে পড়েছো সেই খাঁচায়। সে খাঁচা টিকে আছে তোমার স্বপ্নের দামে, তোমার ত্যাগের মহিমায়। “রমনীর গুনে” তুমি সুখে ভরিয়ে তুলছো খাঁচাটার প্রতিটি ইট কাঠ। এই খাঁচা শুধু তোমাকেই বন্দি করেছে। ভাবছো ভালোবেসেছো তুমি সেই খাঁচাকে। সত্যিই বেসেছো তো?
তুমি আর তন্বী উর্বশী নও। তোমাকে মেয়ে বললে আর মানায় না। তুমি এখন নারী। স্ত্রী এবং মা। ভাবী, চাচী, মামী এবং বউমা হয়েছো। শরীর ভাঙছে তোমার, ভাঙছে মনও। ডানা দু’টো কাটা পড়েছে আগেই। সংসারের বেঁধে দেয়া ভূমিকায় মানিয়ে চলার প্রাণান্তকর অভিনয় করে চলেছো দিনরাত।
জীবন নিয়ে বাজী খেলার দিন গত হয়েছে তোমার, নিজের জীবনের ভাগ আর তোমার নেই। কয়েক টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে অবুঝ, কচি মানব শিশুর হাতে। নিজেকেই গড়া হয়নি পুরোটা, তবু সেই শিশুকে গড়ার ভার তোমার কাঁধে।
নিজের স্বপ্ন পুরণে এক পা আগালে দুই পা পিছিয়ে আসো তুমি, আপোষ করো স্বপ্নের সাথে, ভালোবাসার সাথে, প্রতিবাদের সাথে, নীতির সাথেও কখনো কখনো। অধরা রয়ে যায় জীবনের অনেক স্বাদ, অনেক আহ্লাদ। ছুটি দিয়েছো তাদের, নিজেও ছুটি নিয়েছো একান্তে।
পরিস্থিতি তোমাকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। মনে না নিলেও মেনে নিচ্ছো প্রায়ই। জীবন তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে মাঝ বয়সে এসে। তোমার সব মনে থাকে। ছেলের কোচিং, মেয়ের গানের স্কুল, স্বামীর প্রিয় খাবার, আত্মীয়তার আর সামাজিকতা রক্ষার দায়, কোনটাই ভুলো না তুমি। শুধু নিজেকেই ভুলে যাও ক্ষণে ক্ষণে।
তোমার হাড়ের ব্যাথা, তোমার চোখের কোলের কালি, তোমার জমানো না পড়া বইগুলো, তোমার একলা বিকেলের চা আর টোস্ট, তোমার জন্যে অপেক্ষা করে। তুমি তাদের দিকে ফিরেও তাকাও না। তোমার অতো ফুসরতই নেই।
তুমি সব পারো। সংসারটাকে সুন্দর করে গড়তে পারো। সন্তানের যত্ন নিতে পারো। তুমি ভালো গৃহিনী। সবাই তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তুমি যদি কর্মজীবী হও, তবে তো পোয়াবারো। দশভূজার মতো সামাল দাও ঘর ও বাহির। শুধু নিজেকে ভালোবাসতে পারো না কেন যেন। তোমার ভালোবাসা কথাটার গায়ে জমেছে অস্বস্তি আর সংকোচের শ্যাওলা।
শুধু পার্লারে গিয়ে রূপ ফেরাবার ভালোবাসা নয়। গহনা আর দামী কাপড়ের ভালোবাসা নয়। এভাবেও হয়তো ভালোবাসে অনেকে। কিন্তু আমি তোমার স্বপ্নদের কথা বলছি, তোমার সম্ভাবনার কথা বলছি, তোমার আনন্দের কথা বলছি। তাদের ডাক শুনছো কি তুমি? তাদের ভালোবাসছো তো?
নিজেকে ভালোবাসা, নিজের স্বপ্নকে ভালোবাসা কেবল তন্বী তরুণীর একচেটিয়া নয়, তোমারও। মাঝ বয়সে এসে সেকথা ভুলে গেছো তুমি। যেমন ভুলে যেতেন আমাদের মায়েরা, তাদের মায়েরা, তাদের মায়েরা। সময় বদলেছে, শুধু তুমিই বদলাতে পারো না কেন যেন।
বংশ পরম্পরায় ধরে রাখো ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি – নিজেকে, নিজের স্বপ্নকে, নিজের ভালোবাসাকে।
ভালোবাসার দিনে তাই তোমাকেও ডাক দিয়ে যাই, নিজেকে একটু ভালোবাসো তো দেখি কেমন পারো। এখনো ফুরোয়নি বেলা। চাইলে তুমি এখনো অনেক কিছু করতে পারো। নিজেকে বিশ্বাস করো, আস্থা রাখো নিজের সক্ষমতায়। লাল শাড়ীতে সাজো বা না সাজো, জীবনের রঙে সাজো তো দেখি। নিজের স্বপ্নের রঙে সাজো।
কান পেতে শোনো, তোমার স্বপ্নেরা অপেক্ষায় আছে আজো। বলছে, তোমার অন্য কিছু হওয়ার কথা ছিলো মেয়ে। শুনতো পাচ্ছো? নিজের স্বপ্নের ডাকে সাড়া দাও, তাদের ভালোবাসো।
এই সংসার একদিন তোমাকে ছাড়িয়ে ছড়িয়ে যাবে বহু দূর। হারিয়ে যাবে স্বপ্নরাও। শুধু তুমি পরে রইবে একা। সেদিন যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলো না। সংসারে সকলকে ভালোবাসো, ক্ষতি নেই। শুধু নিজের জন্যও একটু অবসর রেখো, নিজেকেও একটু ভালোবেসো।