শুদ্ধ নারীবাদ, অশুদ্ধ নারীবাদ

ইশরাত জাহান ঊর্মি: জ্ঞানভিত্তিক সমাজের প্রতি আমাদের একরকম অসূয়া আছে। আমাদের সমাজে কেউ কোনো বিষয় ভালো বুঝলে তাকে টিজ করা হয়। আঁতেল বলা হয়। “ওহ আইছেন বিরাট আঁতেল” এইভাবে বলে বেশি বোঝা মানুষটাকে দমিয়ে দেয়া হয়।

উন্নত দেশে বেশি বুঝনেওয়ালাদের কদর থাকলেও আমাদের দেশে নেই। কেন নেই? এইটা কি কখনও ভাবি আমরা? একটা দায় কিন্তু বেশি বুঝনেওয়ালাদেরও আছে। কারণ বোধহয় এই যে যারা বেশি বোঝেন, ভালো বোঝেন তারা অন্যদের খারিজ করে দেন। নিজে এবং নিজে প্রভাবিত এমন মানুষ ছাড়া আর সবাইকে মূর্খ ভাবার একটা অদ্ভুত আচরণ তারা করে থাকেন। অন্যরা মূর্খ তাই তাদের থেকে জ্ঞানীরা একশ হাত দূরে থাকেন। তার জ্ঞান অন্যদের মধ্যে ছড়ানোর কোনো দায় এই আলোকিত মানুষেরা নেন না। সবাই আব্দুর রাজ্জাক হয়ে যান।

ইশরাত জাহান ঊর্মি

আব্দুর রাজ্জাক জ্ঞানতাপস ছিলেন, কিন্তু জীবনে একটা বইও লিখেন নাই। তাঁকে নিয়ে আহমদ ছফা লিখেছিলেন যদ্যপি আমার গুরু…
আবার আরেক দল আছেন তারা হয়তো জ্ঞানটা ভাগ করতে চান। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে চান? শুধুই শুদ্ধ জ্ঞান বিতরণ? তাদের বিতরণের ঢঙে বোঝা যায়, তারা কোন একটা বিশেষ এজেন্ডা নিয়ে, বিশেষ কাউকে দমাতে বা ঠেকাতে এই জ্ঞান বিতরণের মুখোশ পরছেন। অথবা যাদেরকে মূর্খ বলছেন তাদেরকে আসলে হয় ভয় পাচ্ছেন, অথবা ঈর্ষা করছেন তাদের মতোই বলতে, ভাবতে বা লিখতে না পেরে।
যেকথা বলতে এতো কথা। নারীবাদ বোঝা, না বোঝা, না পড়ে নারীবাদ করা ইত্যাদি বিষয়ে উইমেন চ্যাপ্টারের কয়েকটি লেখা পড়লাম। সম্পাদক সুপ্রীতি ধর বললেন আমার ভাবনা লিখতে।

শান্তা মারিয়া তাঁর লেখায় “কিছু নারীবাদীর তর্জন-গর্জন” এর কথা বলতে গিয়ে জানালেন, তারা (এই মূর্খ নারীবাদীরা) বলতে চাইছেন “লেসবিয়ান হলেই নারীর মুক্তি, বিয়ে না করলেই নারীর মুক্তি, সংসার থেকে বেরিয়ে এলেই নারীর মুক্তি, চুল কেটে ফেললেই নারীর মুক্তি, কেউ আবার গালাগালির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন।”

আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে চাই এই প্রত্যেকটা “তর্জনগর্জন” কেই আমি সহি মনে করি। তার আগে বলি অনেক অনেক জ্ঞানের কথা বললেও উনি লেসবিয়ান যে হওয়া যায় না-এইটা বায়োলজিক্যাল- তা ভুলে গেলেন। কে সুখের সংসার ভেঙে নারীকে নারীবাদ করতে বলেছে, কোন নারীবাদী বিয়ে না করলেই নারীর মুক্তি ভাবছেন, কোন নারীবাদী চুল কাটাকে নারীবাদ ভাবছেন, সেই নারীবাদীরা কতখানি শক্তিশালী যে তারা সমাজকে ভুল বার্তা দিচ্ছেন, আমি তাদের নাম লেখকের কাছে স্পষ্ট করে জানতে চাই। যে বিষয়গুলো উনি বললেন এবং এমনভাবে বললেন যে এটা আপত্তিকর-এইখানেই আমার আপত্তি। লেসবিয়ান হওয়াটা দোষের না এবং এইটা নারীবাদের সাথে সম্পর্কিত না, চুল কাটা এবং বিয়ে সংসার বিষয়ক ভাবনার ক্ষেত্রেও আমার একই কথা।

তিনি অ্যাঙ্গেলস এর উদাহরণ দিয়েছেন। এই ভদ্রলোক কিন্তু তার “পরিবার, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি মালিকানা” বইতে বলেছেন, কিভাবে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান বা চুক্তি থেকে নারীর বন্দিত্বের শুরু। একাডেমিক তর্ক হতেই পারে। তর্ক-বিতর্ক খারাপ না, কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী চুল ছোট করে ফেলা নারীবাদীদের শিক্ষা বিতরণ করা? না কি প্রকৃতার্থেই নারীবাদের পাঠ দেওয়া? আর যেকোনো কথা খণ্ডিত করে বললে ভুলবার্তা পৌঁছায়।

উইমেন চ্যাপ্টার এবং নারীবিষয়ক অন্যান্য পোর্টালে আমি এরকম কোনো নারীবাদীর লেখা পড়িনি যে বলছেন, সংসার ভেঙে চলে এলেই নারীর মুক্তি হবে। নারীমুক্তি যে হঠাৎ করে কারো চুল কেটে ফেলায় বা লম্বা করে ফেলায় হবে না, কারো সাজগোজ করা না করায় হবে না, তা তো একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। আমার প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে এই তত্ত্বগুলো সামনে আনার বিশেষ কারণ আছে কি?

পশ্চিমের কয়েকজন নারীবাদী লেখকের কথা লেখক তার লেখায় এনেছেন। এঁদের লেখা না পড়ে নারীবাদ হবে না বলে মনে করেন তিনি। আমার প্রশ্ন হলো, আমাদের নারীবাদীরা যদি এঁদের মতো করে বলেন, করেন, লেখেন, তাহলে সেটা এই সমাজ মানবে? আবার এই সমাজের সাথে মানিয়ে মানিয়ে নারীবাদ করলে কবে আপনি গন্তব্যে পৌঁছাবেন সেটা কি জানেন?
এখনকার নারীবাদী লেখকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী কী? শান্তা মারিয়ার মতে, মূর্খ, দুএকটা বই লিখেই নিজেদের বিরাট কিছু ভাবা, চুল ছোট করে ছাটা, পূর্বসুরীদের বাতিল করে দেওয়া।
আর পুরুষদের অভিযোগগুলো হলো, পরকীয়ার পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া, সফট পর্নোগ্রাফি লেখা। আরও কিছু অভিযোগ আছে, যেমন নিজেকে পণ্য করে তোলা।
আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে যে ভাষাগুলো একইরকম লাগে। নারীর মোড়কে যখন তারা পুরুষের কথা বলে যান।

একজন নারীবাদী যিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে চান, দুজন মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে পরকীয়া-আপনকীয়ায় বাঁধেন, তিনি কি মানুষের মুক্তি চান? রাস্তায় নোংরা কথা যে পুরুষটি বলে সে কী বললো, তার বিকৃতি কতখানি, তা তুলে ধরতে হলে আপনাকে তার বলা বাক্যটিই লিখতে হবে।

এইখানে গালাগালি বা সফট পর্নো কে লিখলো? নারী না পুরুষ?
যাই হোক, শান্তা মারিয়ার লেখা থেকে আমি অন্তত এটা বুঝলাম যে, এতো এতো প্রাত:স্মরণীয়দের লেখা না পড়েও, সমাজতন্ত্র না বুঝেও যারা নারীবাদ করছেন তারা একেবারে ফেলনা নন, এই মূর্খদের কিছুতেই ইগ্নোর করা যাচ্ছে না, তারা যে অশুদ্ধ, “সহী না” এরকম নারীবাদ প্রচার করছেন তাদের খারিজ করা যাচ্ছে না। এইটাও কিন্তু শক্তি।

একজন নারী শুধু নারী হয়ে জন্মানোর কারণে যে যন্ত্রণা সমাজ সংসার রাষ্ট্র থেকে পান, সেটা উপলব্ধি করা এবং করে লিখতে পারা যেকোনো টেক্সট থেকেও অনেক জরুরি। নিজের জীবন থেকে বড় টেক্সট আর কিছু নেই, হতেই পারে না। তাই অহেতুক শ্লেষ করে পুরুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেবার কাজটা আমরা নাইবা করলাম। নারীবাদ তার পথ নিজেই খুঁজে নেবে। বিশুদ্ধবাদীরা ভয় পাবেন না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.